নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২১ সালে অন্তত ৮০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন; যা মানবাধিকার লঙ্ঘন সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এ বছর আইনশৃঙ্খলা বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ারে ৫১ জন, নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে আটজন, কারাগারগুলোতে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে ৮১ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে আসক। গতকাল শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২১: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়।
আসকের মহাসচিব নূর খানের মতে, ২০২১ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। সারাদেশ আজ ভয়ের চাদরে আবৃত। বিচারহীনতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, ধর্ষণসহ সমাজে এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়েছে, যা ভীতিকর। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ নানা কারণে বছরজুড়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষক, নারী-অধিকারকর্মী, বিরোধী দল, সমালোচক ও আইনজীবীদের জন্য পরিস্থিতি প্রতিকূলে ছিল।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮০ জন মানুষ।
ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের
দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের সমালোচনা করে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের এ ধরনের বক্তব্য প্রকারান্তরে বিচারবহির্ভূত হত্যা বা ‘ক্রসফায়ার’কেই উৎসাহিত করে, যা প্রকৃতপক্ষে দেশের সংবিধান প্রদত্ত মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার হরণসহ আইনের আশ্রয়লাভসংক্রান্ত সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থি।’
ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গোলাগুলিতে নিহত: আসক তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধ/গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন ৫১ জন।
হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু: আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব মতে, ২০২১ সালে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছেন আটজন। এর মধ্যে গ্রেপ্তারের পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শারীরিক নির্যাতনে ছয়জন, হার্ট অ্যাটাকে একজন এবং গ্রেপ্তারের আগে শারীরিক নির্যাতনে নিহত হন একজন।
অন্যদিকে এ বছর দেশের কারাগারগুলোতে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ৮১ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৯ জন এবং হাজতি ৫২ জন। ২৮ মে খাগড়াছড়ি জেলা কারাগারে মিলন বিকাশ ত্রিপুরা নামে এক বন্দি মারা যান। তার মাথায় আঘাত ও গলায় গামছা প্যাঁচানোর দাগ দেখা গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুম: প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অব্যাহত থাকার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যম বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার গুমের বিষয়ে বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। অপরদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলছে, গুম-খুন নিয়ে তদন্ত করার ক্ষেত্রে তাদের আইনি সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আসকের তথ্যানুসন্ধানে গুম বা অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, গুমের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য; বিশেষ করে র?্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেয়া হয় এবং এরপর সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন সাতজন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন একজন।
সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার পরিস্থিতি: প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার পরিস্থিতির ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক ছিল ২০২১ সাল। প্রতিবেদনে বলা হয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন, ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের নানুয়ার দীঘি পূজামণ্ডপে ‘কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় উসকানিমূলক পোস্ট দেয়ার পর উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী কুমিল্লার ওই মণ্ডপে হামলা-ভাঙচুরসহ ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। কুমিল্লার ঘটনার পরপরই চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পূজামণ্ডপ ও মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর, বাড়িঘর ও দোকানপার্টে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মারধরের ঘটনা ঘটে নোয়াখালীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের একজনকে পিটিয়ে হত্যা ও আরেকজনের লাশ উদ্ধারসহ দুজন নিহত হন।