২০২২ সালে আলোর পথে শুরু হোক যাত্রা

কাজী সালমা সুলতানা: বিদায় ২০২১ সাল। বিশ্বব্যাপী মানবজীবনে এক সংকটময় দুর্যোগ নিয়ে পেরোলো গত দুই বছর। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর মধ্য দিয়ে সেই আতঙ্ক বাস্তবে রূপ নেয়। প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয় ২০২০ সালের ১৬ এপ্রিল। এর পর থেকে আজ ২০২১ সালের শেষ দিন পর্যন্ত দেশে বর্তমানে মোট শনাক্ত রোগী ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ২৭ জন। মারা গেছেন ২৮ হাজার ৬০ জন।

এরই মধ্যে করোনা তার রূপ পরিবর্তন করে করোনা ডেল্টা থেকে ওমিক্রন ও ডেলমিক্রনে পরিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবছর ডেঙ্গুর সঙ্গে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছিল। এতেই দেশের মানুষ পেরে উঠছিল না। এ অবস্থায় হঠাৎ করে করোনা মহামারির কারণে বন্ধ হয়ে যায় দৈনিক কর্মক্ষেত্রে যাওয়া মানুষের কাজ। ফলে বাড়ে হতাশা, বেকারত্ব ও আত্মহত্যার ঘটনা।

বাড়তে থাকে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। যারা কখনও দান গ্রহণ করেননি, এমন ভদ্র পরিবারগুলোকেও দান নিতে দেখা যায়। প্রতিটা পরিবার যেন একঘরে হয়ে যায়। অনেক পরিবার নতুনভাবে জীবনকে উপলব্ধি করতে শেখে। আবার অনেক পরিবারেই দ্বন্দ্ব বাড়তে দেখা যায়। দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়। রাজধানী ঢাকা ছেড়ে অনেক পরিবার শুধু জীবন বাঁচাতে গ্রামে চলে যায়। সরকার করোনা প্রাদুর্ভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে, কিন্তু সেই উদ্যোগ জনগণের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই না পৌঁছানোর কারণে সে উদ্যোগ কোথাও কোথাও সমালোচিত হয়। করোনার প্রথম দিকে নকল মাস্ক ও পিপিই নিয়ে

এবং করোনার পরীক্ষা নিয়ে ব্যপক দুর্নীতি প্রকাশিত হলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। তবে অপরাধীরা রয়ে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

করোনার নমুনা নিয়ে পরীক্ষা না করেই অনেক হাসপাতাল রিপোর্ট প্রদান করে বিপত্তি সৃষ্টি করে। একের পর এক দুর্নীতি প্রকাশিত হতে থাকে। এরই মধ্যে মানুষের জীবনযাপনে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন দেখা যায়। পবিবারের গুরুত্ব জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে ওঠে। একসঙ্গে টেবিলে বসে খাওয়া, ঘরের কাজগুলো ভাগ করে নেয়া, বাগান করা, রান্না করাÑএসব ফিরে এসেছে আমাদের পারিবারিক জীবনে। মানুষ বুঝতে শিখেছে, জীবনে কত কম চাহিদায় খুশি থাকা যায়।

বিশ্বব্যাপী এখন করোনা প্রতিরোধে অপরিহার্য মাস্ক ভবিষ্যতেও ধুলা প্রতিরোধে ও সুস্থ থাকার ক্ষেত্রে ব্যবহারে দীর্ঘমেয়াদি হবে। এজন্য এরই মধ্যে সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ চালু করেছে। কিন্তু মাস্কের ব্যবহার শহরের বাইরে দেখা যায় কম।

২০২১ সালেও করোনার প্রাদুর্ভাবের মাঝে বেড়েছে ইন্টারনেট ব্যবহার। টেলিমেডিসিন ডাক্তার দেখানো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকা, বন্ধু-আত্মীয় সবার সঙ্গে অডিও-ভিডিও কলে যোগাযোগ রাখা, হোম অফিসের কাজ ও ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করা, ছাত্রদের অনলাইনে ক্লাস করাÑএসবই বাড়িয়ে দিয়েছে প্রযুক্তির অপরিহার্যতা। দুনিয়াজুড়েই বেড়েছে অনলাইনে খাবার, খাদ্যসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় সবকিছু বাসায় হোম ডেলিভারি আনার প্রবণতা । মাস্ক পরা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাপন, জনসচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এ বিষয়গুলোই হয়তো সবসময়ের জন্য নাগরিকের জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ হয়ে থাকবে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলা করে আর্থ-সামাজিক উন্নতিসহ বসবাস-উপযোগী নিরাপদ শীর্ষ ২০ দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের এক সূচকে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘কভিড সহনশীলতা র‌্যাংকিং’ শীর্ষক তালিকা অনুসারে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ সব দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে জিডিপি ধরে রাখার ঘটনাকে বাংলাদেশের সরকারের সাফল্য বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আক্রান্ত ও মৃত্যুহারের পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে এ বছরও বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।

করোনার কারণে দেখা দিয়েছে মানসিক ব্যাধি। অনেক পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন এই ব্যাধিতে। ভবিষ্যতে বিশ্বের মানুষের মানসিক সুস্থতা রক্ষা করার যুদ্ধটাও আমাদের সামনে প্রকট হয়ে উঠছে।

মহামারি করোনা ও করোনা-পরবর্তী জটিলতায় আমরা অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি, শিল্পপতি, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি সদস্য, সেনাসদস্য, ব্যবসায়ী, আমলা, ব্যাংক কর্মকর্তা, দুদক কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিত্ব হারিয়েছি। তাদের মধ্যে স্বনামখ্যাত বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী অভিনেত্রী কবরী, অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হক, গণসংগীতশিল্পী ও কণ্ঠযোদ্ধা ফকির আলমগীর, সংগীত পরিচালক ফরিদ আহমেদ, সংগীতশিল্পী জানে আলম, একুশে পদকপ্রাপ্ত সংগীতশিল্পী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, ড. ইনামুল হক, একুশে ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত নাট্যব্যক্তিত্ব, বরেণ্য অভিনেতা শিক্ষক ড. ইনামুল হক, টেলিভিশন নাটক, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ অভিনেতা মাহমুদ সাজ্জাদ, একুশে পদক পাওয়া অভিনেতা এসএম মহসীন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান, মুজিবুর রহমান দিলু, শিল্পপতি জয়নুল হক সিকদার, আশা’র প্রতিষ্ঠাতা সফিকুল হক চৌধুরী, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা ও জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান লুনা সামসুদ্দোহা, খ্যাতিমান কলামিস্ট, গবেষক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ, বিশিষ্ট ব্যাংকার ইব্রাহিম খালেদ, লেখক মুশতাক আহমেদ, রাজনীতিবিদ এইচ টি ইমাম, জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খান মাসুদ, প্রবীণ সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, কলামিস্ট তারেক শামসুর রেহমান, শিল্পপতি-ব্যাংকার দ্বীন মোহাম্মদ, সাহিত্যিক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গীতিকার ফজল এ খোদা, একুশে পদকপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী গোলাম মুস্তাফা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপাধি ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের প্রস্তাবক রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক, গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর, বাংলাদেশের সেই বন্ধু, সাংবাদিক সায়মন ড্রিং, কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী, বশীর আল-হেলাল, পদার্থবিজ্ঞানী হারুন অর রশীদ, সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, ছড়াকার, শিশু সংগঠক ও নাট্যকার রফিকুল হক দাদুভাই ও প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে।

সময়ের নিয়মে ২০২১ সালকে হারানোর মাঝে বিদায় জানিয়ে ২০২২ সালকে স্বাগত জানাচ্ছি। প্রত্যাশা থাকুক নতুন বছরে মহামারি করোনা থেকে মুক্ত হয়ে এক সুস্থ পৃথিবী তার স্বাভাবিকতায় ফিরে যাওয়ার। এরই মধ্যে টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। দেশে টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। এদিকে ওমিক্রন ঝড় বিপুল উদ্যোমে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী এবং এ কারণে আমাদের দেশেও আশঙ্কা বাড়ছে।

তবে করোনার দাপট ছাড়াও ২০২১ সাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জš§শতবার্ষিকী। বিজয়ের ৫০ বছরে নতুন উদ্যোমে জাতি শপথ নিয়েছে দেশকে আরও অগ্রগামী করার।

কিন্তু এ বছর ঘটে যাওয়া ক্ষত ছিল দুর্গাপূজার মণ্ডপ, প্যান্ডেল ও হিন্দুদের ওপর আক্রমণ। কুমিল্লায় শুরু হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে যাওয়া সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব যেভাবে হয়েছে, তার ক্ষত মুছে যাওয়ার নয়। দেশজুড়ে নানা সময়ে ঘটেছে নারী নির্যাতন, সবশেষে পর্যটন শহর কক্সবাজারে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন স্বামী-সন্তানসহ বেড়াতে যাওয়া এক নারী।

দেশের নারীরা ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণ ও নির্যাতনের এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা একটার চেয়ে আরেকটা নির্মম। আজও মধ্যযুগীয় বর্বরতায় আজও নৃশংসতার বলি হতে হচ্ছে মেয়েদের।

বাসভাড়া বাড়ানোকে কেন্দ্র করে এ বছর আবারও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা পথে নেমেছিল। দেশে সড়ক নিরাপদ ব্যবস্থা গড়েই তোলা হয়নি, বরং পরিবহন নৈরাজ্য আরও বেড়েছে। বাসে হাফ ভাড়ার দাবিটি কিছুটা আদায় হয়েছে বলা যায়। তবে বাসচালক ও বাস-কন্ডাক্টরদের ভাষা বুঝিয়ে দেয় ছাত্র হওয়া অপরাধ।

বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সরকার। তার পরও দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতা চূড়ান্ত পর্যায়ে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরও যখন সাম্প্রদায়িক শক্তির অবস্থান মজবুত হয়, তখন অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। হারিয়ে যায় আমাদের সংগ্রাম ইতিহাস ঐতিহ্য, আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের অর্জন।

তবুও খ্রিষ্টীয় নতুন বছরের সূচনায় আশা করি, দেশের প্রতিটি স্তরে নিরাপদ জীবনের অধিকার সবার। রাষ্ট্রে সুশাসন কায়েম করা হলেই কমবে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতা। কমবে নারী শিশুর প্রতি সহিংসতা। নতুন বছরের প্রত্যাশা দেশ গোঁড়ামির অন্ধকার থেকে মুক্ত হোক। আলো আসুক জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সবার মনে।

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com