২৪ বছর ধরে কাঠের ঘানি টানছেন আজাদ-আসমা দম্পতি

অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ : গরু কেনার সামর্থ্য নেই। তাই সংসার চালাতে প্রায় ২৪ বছর ধরে খাঁটি সরিষার তেল তৈরির জন্য ৬ মণ ওজনের কাঠের ঘানি টানেন সিরাজগঞ্জের আবুল কালাম আজাদ (৫৫) ও আসমা খাতুন (৪৫) দম্পতি। দশ কেজি সরিষা থেকে ৩ কেজি তেল বের করতে ঘানির জোয়ালে এই দম্পতির হাঁটতে হয় ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার। এভাবেই দুই ঘুগ ধরে ঘাটি টানছেন দরিদ্র স্বামী-স্ত্রী। এক দিন ঘানি না ঘোরালে সংসারের চাকা ঘোরে না তাদের। একভাবে ৮ ঘণ্টা ঘানি টেনে চলেছে তাদের জীবনযুদ্ধ।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রায়গঞ্জ উপজেলার পাঙ্গাসী ইউনিয়নের শ্রী দাসগাঁতী গ্রামের হতদরিদ্র আবুল কালাম আজাদের বাড়িতে দেখা যায় গরুর বদলে তেল তৈরির জন্য ৬ মণ ওজনের ঘানি টানছেন এই দম্পতি। সরিষা থেকে তেল বের করতে দম্পতিকে ঘানি টানতে হয় একটানা আট ঘণ্টা। সেই তেল ও খৈইল বিক্রি করে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা আয় হয়। এই দিয়ে চলে তাদের সংসার। কোনো সঞ্চয় থাকে না। এ অমানবিক পরিশ্রমের মাধ্যমেই তারা ঘুরিয়ে চলেছেন সংসারের চাকা।

জানা যায়, কাকডাকা ভোর থেকে কাঠের ঘানির ওপর কয়েকটি ভারী পাথর চাপিয়ে ঘুরতে থাকেন এ দম্পতি। এভাবে তারা সরিষা থেকে ঘানির মাধ্যমে ফোঁটায় ফোঁটায় তেল বের করেন। শরীর না পারলেও কেবল পেটের তাগিদে সকাল থেকে কত পাক যে তাদের ঘানি ঘুরাতে হয় তার হিসাব জানা নেই। তারা জানে কেবল ঘানির চাকা ঘুরলেই দিন শেষে পরিবারের সবার মুখে এক মুঠো খাবার জুটবে। এভাবেই তারা প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে গরুর বদলে নিজেরাই ঘানি ঘুরান। যে বয়সে তাদের বিশ্রাম নেয়ার কথা, সেই বয়সেই গরুর বদলে টানছেন ঘানি। ঘানি টানার অমানুষিক পরিশ্রম করে অনেকটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে এই দম্পতি। দিনের পর দিন এভাবে ঘানির চাকা ঘুরালেও তাদের ভাগ্যর চাকা ঘোরেনি আজও।

দীর্ঘদিন ধরে তারা অমানুষিক পরিশ্রম করছেও নজর পড়েনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিত্তবানদের। তাদের কপালে জোটেনি সরকারি কোনো সাহায্য -সহযোগিতা। ভাঙা ঘরে সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। দুই সন্তান বড় হয়ে বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। বাবা-মায়ের ঘানি ভাঙানো আয়ে তারা বড় হলেও এখন তাদের দায়িত্ব নিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে এই দম্পতি ঘানির বোঝা টেনে চলেছে নীরবে। কবে তারা এই বোঝা থেকে মুক্ত হবে তা জানা নেই তাদের। একটি ঝুপড়ি ঘরে ঘানির চাকায় কয়েকটি পাথর বসিয়ে ঘুরাচ্ছে তারা।

আবুল কালাম আজাদ জানান, শারীরিক অসুস্থতার কারণে এখন ঠিকমতো ঘানি টানতে পারি না। তবুও এই ঘানি টেনেই তিনি ৬ সন্তানকে মানুষ করেছেন। প্রতিদিন ফজর আজান থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত তারা দুই দফায় ১০ কেজি সরিষা ঘানিতে ভাঙান। এ থেকে ৩ কেজি তেল বের হয়। সেই তেল ৪শ টাকা কেজি দরে বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করেন। আর ৫০ টাকা কেজি দরে খৈল বিক্রি করেন। এ থেকে প্রতিদিন তাদের ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা আয় হয়। তা দিয়ে এখন ৩ ছেলে এবং স্বামী-স্ত্রী খাবার জোটে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। খুব কষ্টে দিন পার করছে তারা।

কালামের স্ত্রী আসমা খাতুন জানান, বিয়ের পর থেকে ঘানি টেনে যাচ্ছি। বয়স

বেড়ে যাওয়ায় এখন আগের মতো ভারী ঘানি টানতে পারি না। মাথা ঘোরে। পা চলে না। মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ি। তবুও পেটের তাগিদে ঘানি টানতে হয়।

এই দম্পতি বলেন, একটি গরু পেলে তাদের খুব উপকার হতো। ঘানি টানার হাত থেকে রক্ষা পেত। শেষ বয়সে একটু ভালোভাবে সংসার চলত।

পাঙ্গাসী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম নান্নু বলেন, সরেজমিনগিয়ে দেখা গেছে স্বামী-স্ত্রী দুইজন মিলে ঘানি টানছেন। পরিষদ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হবে।

রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা তৃপ্তি কণা মণ্ডল জানান, ঘানি টানার বিষয়টি অবগত হয়েছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। শিগগিরই তাদের সহযোগিতা করা হবে।

সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসার পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আমরা তাদের শিগগিরই সহযোগিতা করব।