রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

২ লাখ ৯৮ হাজার অনিবন্ধিত অনলাইন প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে

রহমত রহমান: দেশে প্রতিনিয়ত ই-কমার্স ও এফ-কমার্স ব্যবসার পরিধি বাড়ছে। তবে ভোক্তা ঠকানো ও প্রতারণাÑদুটো থেমে নেই। অনলাইন শপিং ব্যবসার নামে গ্রাহক থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। হাতিয়ে নেয়া সেই টাকা আবার পাচার হয়েছে। ইতোমধ্যে আটটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬৬১ কোটি টাকা পাচার উদ্ঘাটিত হয়েছে। পাচার, ভোক্তা ঠকানো, প্রতারণার পরও দেশে ই-কমার্স ও এফ-কমার্স ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ই-কমার্স ও এফ-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তিন লাখের বেশি। যার মধ্যে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র এক হাজার ৪৯৬টি। বাকি প্রায় ২ লাখ ৯৮ হাজার প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই। অনিবন্ধিত এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন লাখ লাখ পণ্য অর্ডার ও ডেলিভারি দিচ্ছে। যার থেকে সরকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। আবার অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান অবৈধ উপায়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহক থেকে টাকা নিচ্ছে। যাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রাহক প্রতারণার শিকার হচ্ছে বলে বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। রাজস্ব ফাঁকি রোধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে এই প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। প্রতারণা ও রাজস্ব ফাঁকি রোধে প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রিসার্স অ্যান্ড মার্কেট ডটকমের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৬ সালে দেশে ই-কমার্সের বাজার হবে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এটি আরও বাড়তে পারে। কারণ দেশের মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ ই-কমার্স থেকে পণ্য ক্রয় করে। অথচ দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যা ১৩ কোটি। আর ই-ক্যাব বলছে, বর্তমানে দেশে প্রতিদিন প্রায় ছয়-সাত লাখ ডেলিভারি হচ্ছে। প্রতিটি ডেলিভারি, তথা ক্রয়াদেশের গড় দাম ১ হাজার ৪০০ টাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ বাজার রয়েছে ফেসবুক উদ্যোক্তাদের দখলে। ২০২৩ সালে দেশে ই-কমার্সের বাজার ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে ই-কমার্স খাতে প্রায় পাঁচ লাখ উদ্যোক্তা রয়েছেন।

অপরদিকে, এসবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রায় ১০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন, যার মধ্যে ১০ শতাংশ বা এক কোটি ব্যবহারকারী ই-কমার্স বা অনলাইনে অর্ডার বা সেবা নিয়ে থাকেন। দেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ফেসবুক পেজ আছে, যারা এফ-কমার্স বা ফেসবুকে এবং ইনস্টাগ্রামে অনলাইনে ব্যবসা করে থাকেন। এসব ফেসবুক পেজ ও ইনস্টাগ্রামে যারা বিজনেস করেনÑতার মধ্যে ৯৫ শতাংশ এসএমই বা ছোট উদ্যোক্তা, ৪ শতাংশ মাঝারি ও এক শতাংশ মার্কেটপ্লেস বা বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে বৈধভাবে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ১৪২ কোটি টাকা, সেখানে ২০২৪ সালে লেনদেন দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ হাজার ১১২ কোটি টাকায়। এছাড়া ২০২১ সালে প্রায় ১০ হাজার ২১৪ কোটি টাকা, ২০২২ সালে প্রায় ১১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা ও ২০২৩ সালে ১৬ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। তবে অবৈধ লেনদেন হিসাব করলে তা ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মানুষের ই-কমার্স বা অনলাইনে কেনাকাটায় আগ্রহ বাড়লেও সম্প্রতি কিছু কর্মকাণ্ড এবং প্রতারণার কারণে গ্রাহকদের হতাশা বেড়েছে। দ্রুত বিকাশমান অনলাইন বাণিজ্যের সুযোগে প্রতারকচত্র সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণা করছে। যার মধ্যে রয়েছেÑভুয়া সাইট তৈরি করে গ্রাহক থেকে টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করা, ডেলিভারি চার্জের নামে অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করা, জরুরি পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য ধার্য করা, উন্নত পণ্যের ছবি দেখিয়ে নি¤œ পণ্য সরবরাহ করা ইত্যাদি। দেশে তিন লাখের বেশি ই-কমার্স সাইট ও ফেসবুকভিত্তিক এফ-কমার্স ব্যবসা রয়েছে। যার মধ্যে ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেমে (ডিবিআইডি) নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান মাত্র এক হাজার ৪৯৬টি। বাকি প্রায় দুই লাখ ৯৮ হাজার প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই। নিবন্ধন না থাকা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ পণ্যের অর্ডার ও ডেলিভারি হচ্ছে। নিবন্ধন না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ও পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে প্রতিনিয়ত অনলাইনে কেনাকাটা বাড়ছে। প্রতারকচক্র নতুন কৌশলে প্রতারণা করতে পারেন বলে হুঁশিয়ার করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা, ২০২১ অনুযায়ী দেশে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট নিবন্ধন, ই-টিআইএন, পারসোনাল রিটেইল অ্যাকাউন্ট (পিআরএ) বা ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেমের (ডিবিআইডি) অন্তত একটি নিবন্ধন নিতে হবে এবং তা মার্কেটপ্লেস বা সোশ্যাল মিডিয়া পেজে প্রদর্শন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বেশিরভাগ ই-কমার্স সাইট এবং ফেসবুক পেজে তা প্রদর্শন করা হয় না। যার ফলে ভুয়া ও ভুঁইফোঁড় সাইট থেকে পণ্য কিনে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডির হিসাব তদন্তে দেখা গেছে, গ্রাহকের টাকা নিয়ে পণ্য না দেয়া ও টাকা বিদেশে পাচার করেছে আটটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। তদন্ত শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সিআইডি। এর মধ্যে আনন্দের বাজার নামের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ৩০০ কোটি, ই-অরেঞ্জ ২৩২ কোটি, ধামাকা ১১৬ কোটি, রিং আইডি ৩৭ কোটি ৪৯ লাখ, টোয়েন্টি ফোর টিকিট লিমিটেড ৪ কোটি ৪৪ লাখ, এসপিসি ওয়ার্ল্ড ১ কোটি ১৭ লাখ, সিরাজগঞ্জ শপ ৪ কোটি ৯ লাখ, আকাশনীল ডটকম ৩ কোটি টাকাসহ মোট ৬৬১ কোটি ৫১ লাখ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এছাড়া দালাল ডটকম ও থলে ডটকমেরও অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি।

ই-কমার্স ও এফ-কমার্সে প্রতারণার কয়েকটি কৌশলে প্রতিবেদনে তুলে ধরে বলা হয়েছে, ফেসবুক পেজ ও আইডিতে ফেক রিভিউ, কৃত্রিমভাবে অধিক লাইক-কমেন্ট, টাকার বিনিময়ে প্রমোশনাল ইনফ্লুয়েন্সার এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ছবি অবৈধভাবে ব্যবহার করে প্রমোশনাল ভিডিও বা ছবি তৈরি করে। এতে গ্রাহকরা আকৃষ্ট হয় এবং প্রতারণার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আবার গ্রাহকের আস্থা অর্জনের জন্য ভুয়া এনআইডি বা জš§নিবন্ধন কার্ডের ছবি পাঠানো হয়। হোয়াটসঅ্যাপের ক্ষেত্রে অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের শনাক্ত করতে পারে না। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ব্যবসা করা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই। এফ-কমার্স এসব প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে মোবাইল ব্যাংকিং বা এমএফএস ব্যবহার করে লেনদেন করে। অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমএফএস নীতিমালা প্রয়োগ হয় না বিধায় প্রতারণার পরিমাণ বাড়ছে। গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ বলছে, মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির অসৎ কর্মকর্তা ও সিম বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম উচ্চমূল্যে প্রতারকদের সরবরাহ করা হয়। ফলে ওই নাম্বারের সিডিআর ও নিবন্ধিত এসআইডি বিশ্লেষণ করে প্রকৃত অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না।

ই-কমার্স ও এফ-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতারণা ও রাজস্ব ফাঁকি রোধ প্রতিবেদনে সাতটি সুপারিশ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছেÑঅনিবন্ধিত ই-কমার্স সাইট ও এফ-কমার্স পেজ শনাক্ত করে বাধ্যতামূলক ডিবিআইডি নিবন্ধন নিশ্চিত করা, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনার জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন, সকল ডিজিটাল কমার্স লেনদেনের জন্য বহির্বিশ্বের মতো ‘এসক্রো’ সার্ভিস চালু করা, নিবন্ধিত ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের ক্ষেত্রে এমএফএস কোম্পানির চার্জ কমিয়ে আনা, ই-কমার্সের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বাইরে যাতে পাচার না হয়Ñসে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং বিটিআরসির মাধ্যমে মেটা করপোরেশনের সঙ্গে আইনগত ও নিয়ন্ত্রণগত ক্ষেত্র সৃষ্টি করা।