রহমত রহমান: প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক নিরীক্ষা হয়েছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। নিরীক্ষার পরবর্তী সময়ে প্রায় ২২ লাখ কেজি কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। বন্ড সুবিধায় আমদানি করা এ কাঁচামালের মূল্য প্রায় ৩৩ কোটি টাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ২৯ কোটি টাকা। এ কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি ও রপ্তানির প্রমাণ নেই। আমদানি করা এই কাঁচামাল বন্দর থেকে ফ্যাক্টরিতেই আসেনি, সরাসরি বিক্রি হয়েছে খোলাবাজারে। আর কাঁচামাল বিক্রি শেষ করেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কুমিল্লা ইপিজেডে অবস্থিত ‘ওয়েসিস হাই-টেক স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার এমন অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে পৃথকভাবে সাড়ে ১০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান শুল্ককর ও অর্থদণ্ড পরিশোধ করেনি। ফলে প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল বা পণ্য স্থানান্তর, আমদানি-রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের দাবি বেপজা প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠান নিলাম করে দিয়েছে বলে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়। তবে ইপিজেডের কর্মকর্তার দাবি, নিলাম হওয়ার পর একজন রিট করে নিলাম আটকে দিয়েছে।
এনবিআর সূত্রমতে, ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট থেকে এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়, যাতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে দুটি মামলা করা হয়েছে। বন্ড ব্যবস্থাপনার পণ্য আমদানি করে তা ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ না করে খোলাবাজারে বিক্রি করে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ায় পৃথক দুটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে একটি মামলায় প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় সাড়ে ৮৮ লাখ টাকা। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এই মামলায় ২০২১ সালের ২৩ মার্চ প্রতিষ্ঠানকে ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়।
অপর মামলায় প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ২৯ কোটি টাকা। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ মামলায় ৩১ মার্চ প্রতিষ্ঠানকে ১০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়। দুই মামলায় অর্থদণ্ডসহ মোট শুল্ককর প্রায় ৩৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানকে অর্থদণ্ড ও ফাঁকি দেয়া শুল্ককর পরিশোধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান অর্থদণ্ড ও শুল্ককর পরিশোধ করেনি। ফলে কাস্টমস আইনের ২০১(১)-এর (এ-ই) ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে, যাতে বলা হয়, সরকারি পাওনা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত এবং বন্ড কমিশনারেটের ছাড়পত্র ছাড়া প্রতিষ্ঠানের কোনো পণ্য ও কাঁচামাল আমদানি-রপ্তানি স্থগিত থাকবে।
অপরদিকে ৩১ মার্চ চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারের বিচারাদেশে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ৫ মে প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে পরিদর্শন করেন বন্ড কর্মকর্তারা। পরিদর্শনের সময় প্রতিষ্ঠানটি ২৪ হাজার ৯০০ কেজি পলিস্টার ফেব্রিক্স দেখাতে পারেনি। কাঁচামাল কোথায়, কীভাবে ব্যবহার হয়েছে এই বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কোনো জবাব দিতে পারেননি।
প্রতিষ্ঠানের নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের ১ মে থেকে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মেয়াদে নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। নিরীক্ষায় সমাপনী মজুত ছিল ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৭১৬ গজ বা চার লাখ ৪৭ হাজার ৯৫৪ কেজি ফেব্রিক্স। নিরীক্ষা-পরবর্তী সিআইএস সেল থেকে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষা-পরবর্তী অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১ মে থেকে ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এক বছরে ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ৭৮২ কেজি ফেব্রিক্স এবং এক লাখ ১১ হাজার ৭৮৫ কেজি এক্সেসরিজ আমদানি করেছে।
কিন্তু পণ্য রপ্তানি করেছে মাত্র ৩৭ হাজার ৭৩৬ কেজি। পরিদর্শনে গুদামে মাত্র চার হাজার কেজি ফেব্রিক্স পাওয়া গেছে। এক্সেসরিজ ও ফেব্রিক্স মিলিয়ে মোট ২১ লাখ ৬২ হাজার ৮৮৬ কেজি কাঁচামাল প্রতিষ্ঠান এক বছরে আমদানি করেছে, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ২৮ কোটি ৭৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৮৩ টাকা। এই কাঁচামাল প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ না করিয়ে সরাসরি খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হলে জবাবে প্রতিষ্ঠানটি বলে, পণ্য রপ্তানি করা যায়নি, কাঁচামাল গুদামে ছিল। চেয়ারম্যান অসুস্থ হওয়ায় প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে চিকিৎসার জন্য তিনি আমেরিকা গেছেন। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে কর্মকর্তারা গুদামে কাঁচামাল পাননি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে ১০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়।
অপর মামলায় বলা হয়, সরেজমিনে পরিদর্শনে গেলে প্রতিষ্ঠানটি ২৪ হাজার ৯০০ কেজি ফেব্রিক্স দেখাতে পারেনি, যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রায় ৪৩ লাখ টাকা, যাতে শুল্ককর প্রায় সাড়ে ৩৮ লাখ টাকা। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়।
এ বিষয়ে ওয়েসিস হাই-টেক স্পোর্টওয়্যারের চেয়ারম্যান জাবেদ আলী শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সাল থেকে বন্ধ। আড়াই বছর ধরে বন্ধ। বেপজা তালা মেরে দিয়েছে। এরপর থেকে আমরা ঢুকতে পারি না। বন্ডের কাঁচামাল ফ্যাক্টরি না প্রবেশ করে খোলাবাজারে বিক্রি ও অবৈধভাবে অপসারণে দুটি মামলা হয়েছে। বিচারাদেশে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জরিমানা হয়েছেÑএ বিষয়ে জাবেদ আলী বলেন, ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের বন্ডের অডিট হয়েছে। যেকোনো একটি কারণে বন্ড কমিশনারেট ২০১১ সাল থেকে আমাদের কাছে শুল্ককর চাইছে। তাদের চ্যালেঞ্জ করবে কে?
মামলা ও বিচারাদেশ হয়েছে, আপনারা কোনো চিঠি পাননিÑএ বিষয়ে তিনি বলেন, ফ্যাক্টরি বন্ধ। বেপজা ফ্যাক্টরি সিলগালা করে দিয়েছে। শুল্ককর পরিশোধ বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ওয়েসিস বলে কোন কোম্পানি নেই। তবে কী কারণে বেপজা তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
এ বিষয়ে কুমিল্লা ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা অকশন করেছি। পরে একজন এ অকশনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেছে। আদালত অকশনের ওপর এক বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এখনও সেই অবস্থায় রয়েছে।