ইসমাইল আলী: নোবেলবিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ রবার্ট লুকাস বলেছিলেন, শুধু সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল থাকলেই যে বিদেশি পুঁজি আকর্ষণ করা যাবেÑএটি সঠিক নয়। দেশের পরিকাঠামো ও পরিবেশ বিনিয়োগযোগ্য হতে হবে। সবার ওপরে দরকার আর্থিক নীতির নির্ভরতা। তাহলেই বিদেশি বিনিয়োগ আসতে শুরু করে। একটি বিদেশি কোম্পানি ভালো ব্যবসা করলে অন্যদের কাছে তার খবর পৌঁছে যায়। আর এতেই বিদেশি বিনিয়োগ আসাটা ক্রমে সহজ হয়ে যায়। সে উক্তিটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য প্রমাণিত।
জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণে অনেকটা একই জায়গায় আটকে আছে বাংলাদেশ। ছয় বছর ধরে দেশে আসা এফডিআই প্রবাহ আড়াই থেকে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের মাঝেই ঘুরছে। ২০১৮ সালে দেশে এফডিআই প্রবাহ এক লাফে দুই দশমিক ১৫ বিলিয়ন থেকে বেড়ে তিন দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার হয়, যা এ পর্যন্ত রেকর্ড সর্বোচ্চ।
এক বছরে দেড় বিলিয়ন ডলার এফডিআই বাড়ার পর আকস্মিকভাবে তা আর বাড়েনি। বরং তিন বিলিয়ন ডলারের আশপাশেই ঘোরাফেরা করছে। যদিও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) কয়েকটিতে এফডিআই প্রবাহ বাংলাদেশের চেয়ে নিয়মিতই বেশি থাকছে। এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গত বছর এফডিআই আকর্ষণে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে ছিল। এছাড়া ২০২৩ সালে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। গতকাল বিশ্বব্যাপী প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে আঙ্কটাড।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে দেশে এফডিআই এসেছিল রেকর্ড সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৬১৩ বিলিয়ন ডলার। ওই বছর এফডিআই প্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ। তবে পরের দুই বছর ধারাবাহিকভাবে দেশে এফডিআই প্রবাহ হ্রাস পায়। এর মধ্যে ২০১৯ সালে দেশে এফডিআই আসে ২ দশমিক ৮৭৪ বিলিয়ন ডলার ও ২০২০ সালে ২ দশমিক ৫৬৪ বিলিয়ন ডলার। ওই দুই বছর বিদেশি বিনিয়োগ কমে যথাক্রমে ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ১০ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
যদিও পরের দুই বছর আবারও দেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ে। এর মধ্যে ২০২১ সালে এফডিআই আসে ২ দশমিক ৮৯৬ বিলিয়ন ডলার ও ২০২২ সালে ৩ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ওই দুই বছর এফডিআই বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৯৫ শতাংশ ও ২০ দশমিক ১৭ শতাংশ। এর মাধ্যমে ২০২২ সালে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এফডিআই আছে। এক বছর না যেতেই আবারও ধাক্কা লেগেছে এফডিআই প্রবাহে। গত বছর তা আবারও কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ০০৪ বিলিয়ন।
যদিও এটি দেশের তৃতীয়বার তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি এফডিআই প্রবাহ এবং পরিমাণের দিক থেকে দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ, তবে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এ পরিমাণ তুলনামূলক অনেক কম। আঙ্কটাডের তথ্যমতে, গত বছর এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ এফডিআই প্রবাহ গেছে কম্বোডিয়ায়। দেশটির পাওয়া এফডিআইয়ের পরিমাণ ৩ দশমিক ৯৫৯ বিলিয়ন ডলার। এর আগেও কম্বোডিয়া ৪ বিলিয়ন ডলার বা তার বেশি এফডিআই প্রবাহ পেয়েছে।
এদিকে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গত বছর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এফডিআই পেয়েছে ইপিওপিয়া, যার পরিমাণ ৩ দশমিক ২৬৩ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া উগান্ডা বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা কম এফডিআই পেয়েছে, যার পরিমাণ ২ দশমিক ৮৮৬ বিলিয়ন ডলার। আর সেনেগালে গত বছর এফডিআই প্রবাহ গেছে ২ দশমিক ৬৪১ বিলিয়ন ডলার, যা এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশে এফডিআই প্রবাহের পরিমাণ কেন আশানুরূপ নয়Ñজানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী কোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে তার পুঁজির নিরাপত্তা চান। সেই নিরাপত্তা বলতে বোঝায় যে, তিনি নিজের মতো করে বিনিয়োগ করতে পারবেন কি না এবং নিজের ইচ্ছামতো তার বিনিয়োগ করা অর্থ ও বিনিয়োগের মুনাফা নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারবেন কি না। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এ দেশের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিনিয়োগের শর্ত রয়েছে। এ শর্ত তারা মানতে নারাজ। আবার অনেক বিষয় আছে যেগুলো আইনে নেই। কিন্তু বিনিয়োগ করতে গেলে নানা অলিখিত নিয়মের বেড়াজালে পড়তে হয়। এর বাইরে পছন্দের জায়গায় জমির প্রাপ্যতা, দক্ষ শ্রমিকের প্রাপ্যতা, অবকাঠামোসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব বিষয় সমাধান করা না গেলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব হবে না।’
প্রসঙ্গত, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বেশিকিছু নীতি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে সেসব উদ্যোগের তেমন কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, দক্ষ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা হবে। কিন্তু গত অর্থবছরের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। এ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগসমূহ কার্যত কোনো ফল দেয়নি। পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, একটি প্রতিযোগিতামূলক ও স্থিতিশীল বিনিময় হার প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি করা হয়নি। বর্তমানে বিনিময় হার নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা (এক্সপেরিমেন্ট) করা হয়েছে গত বছর। এছাড়া পরিকল্পনায় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এছাড়া ব্যবসার খরচ কমানো, উপযুক্ত অবকাঠামো সুবিধা প্রদান, সরকারি সেবা প্রদান সহজীকরণসহ বেশকিছু ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা পরিকল্পনায় বলা হলেও বাস্তবে তা সুদূর পরাহত।
এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পরিকল্পনা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। যেসব উদ্যোগের কথা পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা না হলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে না। তিনি আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য গত বছর বিনিয়োগের নিম্নমুখী প্রবণতা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে কয়েক বছর ধরে এটি একই চক্রে আটকে থাকা উদীয়মান অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়।