Print Date & Time : 19 August 2025 Tuesday 7:12 pm

৫০০ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই, ফিরে গেল মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল

নিজস্ব প্রতিবেদক: কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় থাকা ১৪৭টি পরিবারের ৪৮৬ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে ফিরে গেল মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল। গতকাল বুধবার সকাল ১০টার দিকে টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটি ঘাট দিয়ে ট্রলারে করে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন তারা।

এর আগে ১৫ মার্চ মিয়ানমারের রাখাইনের মংডু টাউনশিপ থেকে ১৭ জনের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সফরে আসেন। এতে নেতৃত্ব দেন দেশটির মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ। সফরকালে তারা টেকনাফ স্থলবন্দরের বাংলোয় অবস্থান করেন।

এ সময় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় (আরআরআরসি) সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ মঙ্গলবার টেকনাফের জাদিমুড়া ও লেদা ক্যাম্পের ১৬ পরিবারের ৪০ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎ নেয়া হয়। সোমবার ২১ পরিবারের ৮৬ জন, রোববার ২৬টি পরিবারের ৭০ জন, শনিবার ২৩টি পরিবারের ৬০ জন, শুক্রবার ১৬টি পরিবারের ৭০ জন, বৃহস্পতিবার ২৩টি পরিবারের ৭০ জন ও বুধবার ২৩ পরিবারের ৯০ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং তথ্য যাচাই করা হয়।

সব মিলিয়ে সাতদিনে ১৪৭টি পরিবারের প্রায় ৪৮৬ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়।

সাক্ষাৎকার দিতে আসা রোহিঙ্গা নেতা সলিম উল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। সবার কাছে প্রায় একই রকমের বিষয় জানতে চেয়েছে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল। যেমন সাক্ষাৎকার প্রার্থীর বাড়ি রাখাইনের কোন গ্রামে ছিল, সেখানকার মেম্বার-চেয়ারম্যান কে ছিলেন, সমাজের সরদার কে ছিলেন, সেখানে থাকতে কতজন সন্তান ছিল, বাংলাদেশে আসার পর কতজন ছেলেমেয়ে জš§ নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আর এখানে (বাংলাদেশে) থাকতে চায় না। আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু এমনভাবে যেতে চাই আর যাতে ফিরতে না হয়।’

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘সাত দিনে টেকনাফ স্থলবন্দরের মালঞ্চ সম্মেলন রুমে প্রায় পাঁচশ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষ করেছে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল। সকালে প্রতিনিধিদলটি মিয়ানমারে ফিরে যায়। যে কাজের জন্য তারা এসেছিলেন সেটি সম্পন্ন করেছেন। প্রতিনিধিদলটি তাদের কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে জানাবে।’

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

জাতিসংঘ সে সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এ হত্যা ও নির্যাতনকে চিহ্নিত করেছিল ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী উদাহরণ’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার চলতি মাসে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো ওই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়ার পর থেকে কক্সবাজার ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশ আর প্লাস্টিকের খুপরি ঘরে বসবাস শুরু করেন রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।

এরপর আসে কবিড-১৯ মহামারি, রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগে ঢিল পড়ে। বিশ্বজুড়ে সেই সংকটের মধ্যেই গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সু চির দ্বিতীয় দফার সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং।

সামরিক জান্তা মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের কয়েক দিন আগে চীনের নেতৃত্ব প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছিল। তার চূড়ান্ত ফল আর পাওয়া যায়নি। ওই সময় বাংলাদেশ আশা করেছিল, ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে হয়ত প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে। সেই পরিকল্পনাও আলোর মুখ দেখেনি।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকারে রাখা বাংলাদেশ সরকার বারবার অভিযোগ করে আসছে, আন্তর্জাতিক মহল প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের এক বছরের মাথায় গত বছরের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে নবগঠিত ‘অ্যাড-হক টাস্কফোর্স ফর ভেরিফিকেশন অব দ্য ডিসপ্লেসড পার্সনস ফ্রম রাখাইন’-এর বৈঠক হয়। এরপর ১৪ জুনে হয় দুদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) সভা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব চ্যান আয়ে বৈঠকে নিজ দেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের যে তালিকা দেয়া হয়েছিল, মিয়ানমারের তা যাচাই করে দেখার কথা। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এখনও ওই পর্যন্তই।