মো. সুলাইমান: েবিগত সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। এসব লুটপাটের অর্থ দেশে থাকেনি, বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। লুটেরাদের ইশারায় এত দিন ব্যাংক খাতের লুটপাট হওয়া টাকা খেলাপি হিসেবে দেখানো হতো না। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেগুলো এখন খেলাপি হচ্ছে। এর ফলে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায়। এর পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে খেলাপি বেড়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৭৬৫ কোটি বা ৭২ দশমিক ৮১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে খেলাপির এমন তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণের এ তথ্যও সঠিক নয়। প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। এ দুই ঋণকে বিবেচনায় নিলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের অঙ্ক সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যত দিন পর্যন্ত খেলাপিদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব না হবে, তত দিন খেলাপি ঋণ কমবে না। বিগত সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। আলোচ্য এ সময়ে খাতটিতে বিতরণ করা ঋণ ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই লাখ কোটি টাকা। এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ছিল এক লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা এবং ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপির সমস্যা সমাধান করা না গেলে ব্যাংক খাত প্রকট আকার ধারণ করবে। ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলবেন। এখনও যাদের আমানত রয়েছে, তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাবে। পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে ব্যাংক থেকে অর্থায়ন কমে যাবে। এর ফলে দেশে কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব পড়বে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুটপাটের চিত্র প্রকাশ্যে আসতে থাকে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণের অঙ্ক। তথ্য বলছে, গত ১৫ বছরে বড় বড় কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা লুট করা হয়েছে। বড় শিল্প গ্রুপগুলোর নামেও এখন ভয়ানক জালিয়াতির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংক খাতের লুটের প্রকৃত চিত্র এতদিন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পান ড. আহসান এইচ মনসুর। ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র খুঁজতে এরই মধ্যে ছয়টি ব্যাংকে ফরেনসিক অডিট শুরু হয়েছে। ফলে খেলাপির পরিমাণও ব্যাপক হারে বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকেই শ্রেণিকৃত ঋণ বা খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের মধ্যে ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের সংখ্যা এখন বাড়ছে, যা এর আগে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। সমস্যা আগেও ছিল। তবে এখন সেই সমস্যাগুলো কার্পেটের নিচ থেকে বের হয়ে আসছে। অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা ঋণগুলো এখন খেলাপিতে ঢুকছে। আবার পুনঃতফসিলকৃত যেসব ঋণের মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেগুলোও খেলাপিতে যুক্ত করা হচ্ছে। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি। এসব খেলাপি ঋণ সরকারের বাজেটের ওপর চাপ বাড়াবে। আবার বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সম্ভবত ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোয় খেলাপি বেশি। বেসরকারি খাতের এসব ব্যাংকগুলোর টিকে থাকার ওপর চাপ তৈরি হবে। অর্থাৎ খেলাপিদের জবাবদিহির আওতায় না আনতে পারলে এককথায় ‘ব্যাংক খাতে কেয়ামত’ তৈরি হবে। তবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এর মানে গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে।
তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার কিছুটা বেড়েছে। এই হার আগের প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) থেকে কিছুটা বেড়ে ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে এই হার ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে।
গতকাল গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আগেই বলেছিলাম, খেলাপি ঋণ বাড়বে। তবে এখনো খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’ তিনি আশ্বস্ত করেন, ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা পেতে কোনো সমস্যা হবে না।
বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতের নানা অনিয়ম লাল কারপেটের নিচে ঢেকে রাখা হতো। তবে বিভিন্ন সময়ে খাতটির নানা অনিয়ম প্রকাশ পেত গণমাধ্যমে। এজন্য আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে এসে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। আর এতে নেতৃত্ব দেন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে রউফ তালুকদারও পলাতক রয়েছেন।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কয়েকটি পদের কর্মকর্তারা আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এখনো ব্যাংক লুটেরাদের সহায়তাকারীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছেন। তাদের নিয়েই ব্যাংক খাত সংস্কারের কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান গভর্নর। তবে গত ছয় মাসে খাতটিতে উল্লেখযোগ্য কোনো সংস্কার হয়নি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক লুটপাটে সহায়তাকারী কর্মকর্তাদের পরামর্শে বর্তমান গভর্নরও আব্দুর রউফ তালুকদারের পথে হাঁটছেন। আহাসন এইচ মনসুরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ সীমিত করতে চাচ্ছেন। গতকাল সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে গভর্নর ভবনের তৃতীয় তলায় সবার প্রবেশ সংরক্ষিত করা হয়েছে। এমনকি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও নিতে হবে অগ্রিম অনুমতি।’ ৫ আগস্টের আগে ঠিক একই কাজ করেছিলেন পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।