৬ বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়ে ২.০৬ গুণ

ইসমাইল আলী : বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণ বেড়েই চলছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই এ ঋণ প্রতি বছর বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছর রেকর্ড পরিমাণ বিদেশি ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরও প্রায় সমপরিমাণ বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে। এতে ছয় বছরে বিদেশি ঋণ দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন (৯ হাজার ৪৫০ কোটি) ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ৬৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি ঋণ ২৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বিদেশি ঋণের মধ্যে ৭২ দশমিক ৫৪ শতাংশই সরকারি ঋণ।

এদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে বিদেশি উৎস থেকে নেয়া দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। অর্থাৎ ছয় বছরে বিদেশি ঋণ বেড়ে দুই দশমিক শূন্য ছয় গুণ হয়েছে। এছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ছিল ৫৬ দশমিক শূন্য এক বিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে ৬২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে ৬৮ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার ও ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে ৮১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন

এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে (২০২১-২২ অর্থবছর) বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে ১২ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছর বিদেশি ঋণ বেড়েছিল ১২ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদেশি ঋণের এ উল্লম্ফন ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, দেশে এ মুহূর্তে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। আগামীতে এ সংকট আরও গভীর হবে। এ অবস্থায় বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও চাপে পড়তে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুন শেষে বিদেশি উৎস থেকে নেয়া ঋণের মধ্যে সরাসরি সরকারের ঋণ রয়েছে ৫৬ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণের পুরোটাই দীর্ঘমেয়াদি। বাকি ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। আর ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে সরাসরি সরকারের ঋণ ছিল ৫২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। সে সময় সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ঋণ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সরকারের মোট বিদেশি ঋণ বেড়েছে ১৫ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছর তা বেড়েছে সাত দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে সরকার বিদেশি ঋণে বাস্তবায়নের জন্য বেশকিছু মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পগুলোই মূলত সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে অন্যতম রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল ও দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর বিদেশি ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। আর সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছর বিদেশি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

ঋণের এ দ্রুত বৃদ্ধির হার বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, গত কয়েক বছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ এসেছে সেটি স্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে সরকারি এমনকিছু প্রকল্পে বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে যেগুলোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। এতে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে, যা অর্থনীতিকে চাপে ফেলতে পারে। আর সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে, রিজার্ভও কমছে। তাই বিদেশি ঋণ পরিশোধ আগামীতে ডলার ও রিজার্ভের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তখন বিনিময় হারও দ্রুত পরিবর্তন হবে।

উল্লেখ্য, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থা থেকে নেয়ার ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। এর প্রায় পুরোটাই সহজ শর্তের ঋণ। আর দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ ২৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। এর প্রায় অর্ধেক সহজ শর্তের ঋণ। বাকি ঋণের বেশিরভাগই কঠিন শর্তের।