সাইফ ইসলাম দিলাল: পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের মানুষের ওপর গণহত্যা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে চলে তাদের গণহত্যা। নয় মাসব্যাপী সংঘটিত বিস্তৃত ঘটনাবলির সচিত্র প্রতিবেদন; যা পৃথিবীর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে সেসব একাধারে সংগ্রহ করতে শুরু করেন তৎকালীন কমার্স ব্যাংকে কর্মরত ব্যাংকার, লেখক ফজলুল কাদের কাদেরী। আমাদের গর্বিত রক্তঝরা একাত্তরের দিনগুলোতে প্রতিটি বাঙালি যখন লড়ছে নতুন জীবনের জন্যে, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি জীবনের প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে একটি অনন্য সাধারণ কাজ সমাধান করে ফেললেন একজন শব্দসৈনিক হিসেবে। পাক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, ধ্বংস আর হত্যালীলা পৃথিবীর ছোট বড় সব সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে ছবিসহ ছাপা হচ্ছিল। তিনি এবং তার কয়েকজন বন্ধুসহ এগুলো সংগ্রহ করেন এবং ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করলেন বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস cÖm (Bangladesh ‡enocide and World press) মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সচিত্র দলিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রক্তঝরা স্বাধীনতার পরপরেই কাদেরীর এ অনন্য সৃষ্টিতে স্তম্ভিত এবং অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে লেখক বইটা দেন। বইটা হাতে নিয়ে জাতির জনক বলেছিলেন ‘এইটা তুই কী করছস!’
তারপর বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে সরকারি খরচেই কাদেরী ভারতে গিয়ে বইটি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল মি. এ এল ডায়াস এবং মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের হাতে তুলে দিলেন। বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস গ্রন্থটি ৫৪টি দেশের ১০৮টি সংবাদপত্রের ভাষ্য ও প্রতিবেদন-সংবলিত প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার বইটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমূল্য দলিল এবং গবেষণার জন্য সূত্রগ্রন্থ। পরবর্তী সময় এ বই ১৯৭১’এর গণহত্যার অন্যতম তথ্যভাণ্ডারে রূপান্তর হয়।
ফজলুল কাদের কাদেরী এক জায়গায় লিখেছেন, প্রেস সেন্সর ও সংবাদ পাঠানোর ক্ষেত্রে বাধানিষেধ আরোপ করায় বাংলাদেশ থেকে কোনো সংবাদ বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল না। সে কারণেই বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে শুরুতে কিছু জানতে পারেনি। কিন্তু ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে ছবিসহ বিদেশি সংবাদপত্র বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে। কতিপয় সদস্য দেশ ছাড়া জাতিসংঘ ও এর অপরাপর সদস্য দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে সচেতন হয় এবং পাকিস্তানের বর্বরোচিত গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানি নৃশংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত ক্রমান্বয়ে জাগ্রত হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের জন্য পাকিস্তান সরকার তার দখলদার বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী গড়ে তোলে। এসব বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে হত্যা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বুদ্ধিজীবীসহ অনেক লোককে তারা জিজ্ঞাসাবাদের নামে ধরে নিয়ে যায় এবং এদের খুব কমই জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন। তাদের গণহত্যা ক্যাম্পে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয়, বেয়নেট দ্বারা খুঁচিয়ে তাদের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে শেষ পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনী ও তাদের সমর্থকদের ধূলিসাৎ করে দেয়াই ছিল গণহত্যার প্রধান লক্ষ্য। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে। জাতিসংঘের গণহত্যাবিষয়ক কনভেনশন এবং মানবাধিকার-বিষয়ক সর্বজনীন ঘোষণা অনুযায়ী গণহত্যার যেভাবে বিচার হওয়া উচিত ছিল ১৯৭১-এর এ নৃশংস গণহত্যার হোতাদের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো আন্তর্জাতিক উদ্যোগ আজও গৃহীত হয়নি।
১৯৭৫ সালের পর দীর্ঘ প্রায় এক দশক ফজলুল কাদের কাদেরী তার কর্মস্থল অগ্রণী ব্যাংকে পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। তিনি বলতেন, একজন দোর্দন্ত প্রতাপশালী ব্যবস্থাপনা পরিচালক বদলির চার দিন পর তাকে সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। তিনি প্রায় আক্ষেপ করে বলতেন, ব্যাংকিং কর্মজীবনে বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মের জন্য প্রশংসিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লেষ বা এসব কর্মকাণ্ডের জন্য বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রায় ৪০ বছর বিভিন্ন ব্যাংকে চাকরি করেন। সরকারি অগ্রণী ব্যাংক থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি বেসরকারি ইউসিবিএল, এনসিসি ব্যাংক, এসআইবিএল ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক ফজলুল কাদের কাদেরীর পেছনে ফিরে বই থেকে এখানে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। ‘১৯৭১ সালটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি স্মরণীয় বছর। এ বছরেই সংঘটিত হয় বিশ্বের জঘন্যতম গণহত্যা এবং বাঙালির গর্বের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জন। মুক্তিযুদ্ধে শরিক হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলে মা, স্ত্রী ও আমার সেজ মামা বাদ সাধলেন। কারণ আমার ওপর নিজের সংসার ছাড়াও বিধবা বোনের সংসার চালানোর দায়িত্ব ছিল।
তবে আমার বোনের এক ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র, সে কাউকে না বলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চলে যায়। একদিকে দেশের জন্য টান, অন্যদিকে স্বজনের আহাজারি, শেষ পর্যন্ত আমাকে দেশেই থাকতে হলো। দেশে থাকলে কী হবে, মন তো আর বাঁধ মানে না। তাছাড়া শ্বশুর সাহেব (আশরাফ আলী চৌধুরী) আওয়ামী লীগের এমসিএ ছিলেন। তখন তিনি ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছিলেন। ফলে আমাকে খুব সাবধানে চলতে হয়েছে।
নিজের ব্যাংকিং কাজের শত ব্যস্ততার মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের খবর, গেরিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ ব্যাপারে আমরা কয়েকজন জড়িত ছিলাম। ব্যাংকার হিসেবে একমাত্র আমিই ছিলাম। অন্যরা সব ছিলেন সাংবাদিক। শহীদ নিজামউদ্দিন, শহীদ নজমুল হক, শহীদ সিরাজউদ্দিন, শহীদ আবুল বাসার, হেদায়েত হোসেন, জাতীয় কবি শামসুর রাহমান, মরহুম আহমেদ হুমায়ুন, মরহুম কালাম মাহমুদ ও কবি ফজল শাহাবুদ্দিন এবং আমলাদের মধ্যে মরহুম এ কে এম মুসা প্রমুখ। ফজল শাহাবুদ্দিন, কালাম মাহমুদ, সৈয়দ নজমুল হক ছিল আমার নিত্য সাথী। মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ এবং গেরিলাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা এবং অন্যদিকে ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজ করা ছিল দীর্ঘ ন’মাসের অন্যতম কাজ।
বিদেশি সংবাদপত্র, সাময়িকী ও অন্যান্য দলিলপত্রাদি সংগ্রহ করে এগুলো টাইপ করে সমমনা মানুষের মধ্যে বিতরণ করে নিজেদের চাঙা করে রাখাই ছিল প্রধান কাজ। এসব খবরাখবরের একটি কপি সযতেœ গচ্ছিত রাখা হতো ব্যাংকের স্ট্রংরুমের ভল্টের ভেতর। এভাবে আমরা পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া জানতে বিদেশি সংবাদপত্র ও সাময়িকী সংগ্রহ করতাম।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আইন করে সব রকম বিদেশি সংবাদপত্র ও সাময়িকী বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তাই কোনো বিদেশি সাংবাদিক ঢাকায় এলে আমরা তার কাছে ছুটে যেতাম খবর সংগ্রহ করতে। তাদের নিজস্ব পত্রিকা বা সাময়িকী যা তারা সঙ্গে করে আনতেন সেগুলো এনে টাইপ করে এবং ছবি থাকলে তা পুনরায় স্টুডিওতে তুলে সেসব পত্রিকা বা সাময়িকী ফেরত দিয়ে আসতাম। খুব গোপনে এসব কাজ করা হতো। দৈনিক বাংলার ফটোগ্রাফার গোলাম মাওলানার ডাকরুমে এবং পুরানা পল্টনে অবস্থিত শাহজান স্টুডিওতে এ কাজগুলো সমাধা হতো। তারপর আসল কপি ব্যাংকের ভল্টে রেখে অন্য কপি এক হাত থেকে আরেক হাত করে আমরা সবাই পড়তাম এবং এভাবে দীর্ঘ ন’মাস নিজেদের মনের দিক থেকে চাঙা করে রাখতাম।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে আমাদের এ ধরনের কাজকর্মের কথা কীভাবে যেন বাইরে জানাজানি হয়। একদিন এক বেলুচ কর্নেল আমার ব্যাংকের শাখায় এসে উপস্থিত। তিনি আমার গ্রাহক ছিলেন। নাম কর্নেল মালিক। তিনি এসে তো রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করে উর্দুতে বললেন, ‘কাদেরী সাব কেয়া খবর ভাই? আপকো হ্যামলোক আপনা আদমি সামঝাথা। আওর আপ গাদ্দারী করর্যাহ হেঁয়।’ আমি অত্যন্ত শান্তভাবে উর্দুতে বললাম, আপনি আমার সম্পর্কে এমন ধারণা কীভাবে করতে পারলেন। আপনি তো আজ ৩-৪ বছর যাবৎ আমাকে জানেন এবং চেনেন। তিনি শুনে বললেন, ‘হ্যাঁ, হাম তো তাজ্জব বন গ্যায়া এ বাত শুন কার, ইসলিয়ে আপসে পুছনে আয়া।’ আমি বসিয়ে চা খাইয়ে তার পুরোনো ধারণাই বহাল রাখার অনুরোধ জানালাম। তিনি খুশি হয়ে ফিরে গেলেন।
আরেক দিন আমি, কবি ফজল শাহাবুদ্দিন ও মরহুম কালাম মাহমুদ ইংরেজি সাময়িকী, নিউজ উইক ৫ এপ্রিল সংখ্যা সংগ্রহ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দেয়ার কথা দিয়ে এক বিদেশির কাছ থেকে নিয়ে ফিরছিলাম। এ বিদেশির খবরটা দিয়েছিল মরহুম এ কে এম মুসা। তৎকালীন ইপিআইডিসির চেয়ারম্যান। ঢাকা ক্লাবের সামনে আমাদের গাড়ি তল্লাশি করার জন্য থামানো হলো। রাস্তায় তখন প্রায়ই গাড়ি থামিয়ে দেখা হতো আমরা কোনো আগ্নেয়াস্ত্র বা বোমা বহন করছি কি না? গাড়ি থামাতেই কালাম মাহমুদের হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে গেল। গাড়ির পেছনের বেয়নট খুলতে হুকুম দিল। আমার ড্রাইভার বারেক (এখন প্রয়াত) পেছন খুলে দেখাল। কিছু নেই।
ফজল শাহাবুদ্দিনের হাতে বইটি পৃষ্ঠা খুলে মোড়া। হাতে বই দেখে জিজ্ঞেস করল, এক কেয়া হ্যায়?’ ফজল শাহাবুদ্দিন বুকে সাহস বেঁধে বলল ‘এ আকবর হ্যায়।’ সৈনিকটি বলল ‘আচ্ছা ঠিক হ্যায় যাও।’ একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দ্রুতবেগে চালিয়ে সোজা দৈনিক বাংলা অফিস। কালাম মাহমুদ তো প্রায় ভিমরি খেয়ে পড়ার অবস্থা। নিউজ উইকের ওই সংখ্যার কভার পেজে শেখ সাহেবের ছবি এবং পেছনে বাংলাদেশের পতাকা ছিল। খুলে দেখলে জীবনলীলা ওই দিনই সাঙ্গ হতো তিনজনেরই। আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রাণে রক্ষা পাই এবং এখনো বেঁচে আছি।
বিজয় দিবসের মাত্র ৪ দিন বাকি। নজমুল হকের বাসায় সকালে কেরোসিন তেল নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন কেরোসিনের চুলায় রান্না হতো। কেরোসিনের খুব অভাব ছিল। আমার ব্যাংকের দোতলায় বার্মা ইস্টার্নের অফিস ছিল। ওদের সাহায্যে বড় দুই টিন তেল জোগাড় করেছিলাম। বাড়িতে কান্নার রোল। জানতে পারলাম রাতে রাজাকাররা ওকে তুলে নিয়ে গেছে। এর আগের দিন সিরাজ ভাইকে চামেলীবাগের বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে। যেহেতু নজমুল ও সিরাজ ভাই বিদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত গণহত্যার সংবাদ সংগ্রহে আমাদের এ গুপ্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাই নিজ বাড়িতে থাকাটা আর নিরাপদ মনে হলো না। ফজল শাহাবুদ্দিনকে ঘটনাটা জানালাম। সেও ঠিক করল যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে হবে।
এদিকে নিজাম উদ্দিনকেও তুলে নিয়ে গেছে। কালবিলম্ব না করে সেদিন দুপুরেই নয়াপল্টন একন আত্মীয়ের বাসায় সপরিবারে আত্মগোপন করি। আমার জান্নাতবাসী মা তখন জীবিত। মা জানালেন সেগুনবাগিচায় তার ভাই অর্থাৎ আমার সেজো মামার বাসায় গিয়ে সবাইকে থাকতে। বাড়িতে দারোয়ানকে রেখে গিয়েছিলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে ওই দিনই বিকালে বাড়ি ছেড়েছিলাম। রাতে রাজাকাররা বাড়িতে হানা দেয় এবং নাম ধরে আমার খোঁজ করে। দারোয়ান কোনো সঠিক উত্তর দিতে না পারায় ওকে মারধর করে চলে যায়। দীর্ঘ ন’মাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে এক দিন নিজ বাড়ি ছেড়ে এখানে ওখানে লুকিয়ে দিন কাটাই। যদি সেদিন বিকালে বাড়ি না ছাড়তাম তবে নজমুল হকের দশা হতো। ফজল শাহাবুদ্দিন ও কালাম মাহমুদও এই ক’দিন বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে ছিল। এভাবে প্রাণে রক্ষা পাই।
একজন ব্যাংকার হয়ে যেসব বিদেশি সংবাদপত্র ও সাময়িকী ব্যাংকের ভল্টে রেখেছিলাম তা সম্পাদনা করে মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম প্রামাণিক দলিল ‘বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস’ বইটি ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে প্রথম প্রকাশ করি। সারাদেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল এ প্রকাশনা দেখে। বঙ্গবন্ধুকে বইটির একটি কপি উপহার দিতে গেলে তিনি আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এইটা তুই কী করছস।’ বইটিকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য আমাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। এর মধ্যে একজনের নাম মনে করতে পারছি এই মুহূর্তে। তার নাম ছিল মির্জা রশীদ আহমেদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি কিছু কাগজপত্র আমাকে দিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বইটির প্রকাশনা উৎসব পালিত হয় তৎকালীন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের অফিসে। অফিসটি তখন ছিল পুরানা পল্টনে এবং এর পরিচালক ছিলেন মরহুম সরদার জয়েনউদ্দিন। প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন শিক্ষা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী মরহুম ইউসুফ আলী চৌধুরী এবং সভাপতি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। সেসব দিন এখন শুধু স্মৃতি হয়েই আছে। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন তৎকালীন দৈনিক বাংলার শাহাবুদ্দিন। আর একই বছরের ২২ অক্টোবর দ্বিতীয় ও বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করা হয়।
ফজলুল কাদের কাদেরীর বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস পরবর্তী সময় বাংলা সংস্করণ প্রকাশ করে সংঘ প্রকাশন। বাংলা প্রকাশের মুখবন্ধনে তিনি লিখেনÑস্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে নজিরবিহীন রক্তপাত আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি, জনসাধারণের আত্মত্যাগ, নিদারুণ যন্ত্রণা, দুর্দশা আর দুর্ভোগ, তাদের আত্মবিশ্বাস আর আস্থা, বীরত্ব আর সাহসিকতাই ছিনিয়ে এনেছিল চূড়ান্ত বিজয় আর গৌরব। সে সময় বাংলাদেশের ওপর প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘটে যাচ্ছিল এসব ঘটনা এবং দূর থেকে স্পর্শ করছিল গোটা বিশ্বকে। সেই অন্ধকারময় দিনগুলোতে বিদেশি পত্রপত্রিকা ও জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ধারাবাহিক বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মিছিল-সমাবেশ আর বক্তৃতা-বিবৃতির প্রতিধ্বনি উঠে এসেছে এসব জ্বলন্ত প্রতিবেদনে। কূটনৈতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার দোসরদের পরিচালিত গণহত্যা আর স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম সম্পর্কে তাদের মনোভাবও তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হয়েছে এ সংকলনে।
তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে: জীবনের যা কিছু তুচ্ছ (১৯৯০), ব্যাংকার ও ব্যাংকিং (১৯৯৩), ব্যাংকিং পদ্ধতি ও সম্পর্কিত আইনাবলী (২০০২), চলার পথে ঘাসের ফুল (যন্ত্রস্থ) ও পিছনে ফিরে দেখা (আত্মজৈবনিক, যন্ত্রস্থ), মধ্যবিত্ত (উপন্যাস, যন্ত্রস্থ)।
সাংবাদিক