প্রতিনিধি, রাজশাহী: শৈশব থেকে দুরন্তপনা মানে কী? পাড়ার মাঠে ছুটে বেড়ানো, স্কুল পালিয়ে রেললাইনের ধারে ঘুরে বেড়ানো, কিংবা দুরন্তপনায় বন্ধুদের আড্ডায় মাতিয়ে রাখা এই চিরচেনা রূপটিই যেন আমাদের চোখে ধরা দেয়। কিন্তু বার্ধক্য যখন দুরন্ত হয়ে ওঠে, তখন সে দৃশ্যপটে একেবারে আলাদা ছবি আঁকে। ৮০ বছরের নতজানু দেহে সাইফুল ইসলামের সেই ছবি যেন সবার ভাবনার ক্যানভাসে আঁকা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নাতিদের সঙ্গে তার ভাব, বন্ধুত্ব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের সঙ্গে, আর জীবনচর্চায় শৈশবের দুরন্তপনার সেই নির্ভেজাল স্পর্শÑসব মিলিয়ে তিনি যেন এক দুরন্ত বার্ধক্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও তার জীবনদর্শনের শিক্ষায় দীপ্তি ঝরে। হাতে দক্ষতা তো দুরন্তই। কথায়, শখে, বন্ধুত্বে, দায়িত্ববোধে আর ভ্রমণে সেই শৈশবের দুরন্তপনা এখনও তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘বার্ধক্য তাহাই যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃত্যুকে আকড়াইয়া পড়িয়া থাকে’Ñকাজী নজরুলের রচনার এই অংশবিশেষের সেই সংজ্ঞাতেও ধরা যায় না সাইফুলের জীবনবোধ। তার জীবনে যা পুরোনো, তা শুধুই মন ও মনের ভেতর সর্বদাই বিরাজমান দুরন্তপনা। রাজশাহীর প্রাণকেন্দ্র নিউমার্কেট এলাকায় ছোট একটি দোকানে বাল্যকাল থেকেই সেলাইয়ের কাজ করছেন সাইফুল ইসলাম। পরিবার নিয়ে থাকেন বিমানচত্বর এলাকায়। চার ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি। মেয়ের মৃত্যু হয়েছে, তবে চার ছেলের ঘরে এখন নাতি-নাতনি। তার সন্তানেরা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সাইফুল ইসলাম নিজের ওপরেই নির্ভরশীল থেকে চলেছেন। কারও কাছে এক টাকার জন্যও হাত পাততে চান না তিনি।
গতকাল বুধবার বিকালে তার দোকানেই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়। বয়সের ছাপ রয়েছে শরীরে, কিন্তু চশমা ছাড়া শারীরিক অন্য কোনো সমস্যা নেই। সুইয়ের সুতা প্রবেশ করাতে তার এক মুহূর্তও লাগে না। যেন বার্ধক্যের ছাপ তার কথা, শখ বা জীবনবোধে একটুও ছুঁতে পারেনি, বরং সেখানে ভরে রয়েছে দুরন্তপনা। সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার কর্মজীবনের শুরু সুই-সুতা দিয়েই। আমার জš§ ভারতে। ১৯৬৫ সালের
দাঙ্গার সময়ে বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে আসি। স্বাধীনতার আগেই নিউমার্কেটের হাসান টেইলার্সে কাজ শুরু করি। পরে ছোট ভাইয়ের অনুরোধে লাইফ টেইলার্সে কাজ নিই। ১৯৭৫ সালে বর্তমান যে দোকানে আছি, সেখানে এসে থিতু হই।
তিনি বলেন, আমার কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। একা একাই নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াই। আমার প্রচুর বন্ধু আছে। প্রতি মাসেই কোথাও না কোথাও যাই। কিছুদিন আগে শিবগঞ্জ থেকে ঘুরে এলাম। বয়স যেন আমার মনে কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। জীবন একই ছন্দে চলছে, যেমনটা এত দিন ধরে চলে এসেছে। উত্থান-পতন নেই বিশেষভাবে। সাইফুল আরও বলেন, আমার সন্তানরা বিশ্রাম নিতে বলে। কিন্তু আমার কাছে বিশ্রাম মানেই অলসতা। আর অলসতা মানেই তা শরীর ও মনকে দুর্বল করে। আমি স্বাধীনচেতা, সহজভাবে জীবন চালিয়ে যেতে চাই; জটিলতাকে বরাবর এড়িয়ে চলি।
তিনি আরও বলেন, এই দোকানটি আমার জীবিকার মাধ্যমই নয়, এটি আমার আত্মসম্মান। আমার কাছে যারা আসেন, তারা শুধু সেলাই করা পোশাক পান না; পান আমার হাতের মমতায় বোনা ভালোবাসা। প্রতিটি সেলাইয়ে থাকে একান্ত যত্ন। এই যত্নই আমাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। আমি প্রতিদিন কিছু না কিছু শিখি। শেখার মাঝে কোনো বিরতি নেই আমার; আমৃত্যু শিখে যাব।
সৎভাবে চলে কবরে পৌঁছানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বাড়ি-গাড়ির কোনো স্বপ্ন নেই আমার। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন সৎভাবে চলেই কবরে যেতে পারি। সন্তানদেরও বলি, এই হাতে কারও উপকার করতে না পারলেও যেন কারও ক্ষতি না হয়। সন্তানদের নিজের আদর্শ ও দক্ষতায় গড়ে তুলছেন জীবনযুদ্ধে দুরন্ত সাইফুল ইসলাম।