নিজস্ব প্রতিবেদক : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এবার দুটি লটে প্রায় ৯২ কোটি টাকার মালামাল ক্রয় করবে। তবে অভিযোগ উঠেছে, পুরো প্রক্রিয়াটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে ঠিক একটি নির্দিষ্ট কোম্পানি ছাড়া আর কেউ বিড করতে না পারে। টেন্ডারের শর্তগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, সেই কোম্পানিই কেবল যোগ্য বিবেচিত হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট এখনও অধিদপ্তরে সক্রিয় রয়েছে। তাদের ছত্রছায়ায় সুবিধাভোগী একটি কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতেই পুরো আয়োজন।
দরপত্রের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর তিনটি ডাম্পার ট্রাক এবং ছয়টি এক্সক্যাভেটর কেনার দরপত্র আহ্বান করে। এই ৯টি পণ্যের মোট প্রাক্কলিত মূল্য ধরা হয় ৯২ কোটি টাকা। ডাম্পার কেনার টেন্ডারে অংশ নেয় সরকার কবির আহমেদ, এইচটিএমএস লিমিটেড এবং বাংলামার্ক করপোরেশন। অন্যদিকে এক্সক্যাভেটর কেনার টেন্ডারে বিড করে সরকার কবির আহমেদ, এইচটিএমএস লিমিটেড, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং সোহেল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।
ডাম্পার কেনার টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল বাংলামার্ক করপোরেশন। তবে এইচটিএমএস লিমিটেড প্রস্তাবিত দামের তুলনায় বেশি দর দেয়। নথি থেকে জানা যায়, এইচটিএমএস লিমিটেড উভয় ক্ষেত্রেই ক্যাটারপিলার ব্র্যান্ডের পণ্য সরবরাহের প্রস্তাব দেয়। একমাত্র তারাই টেন্ডারের সব শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু দরের কারণে তাদের কাজ দেয়া সম্ভব হয়নি। এরপর নতুন করে আবারও টেন্ডার আহ্বান করা হয়।
২০ মে প্রকাশিত নতুন টেন্ডার নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এবারও শর্তগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে কেবল ক্যাটারপিলার ব্র্যান্ডের সরবরাহকারীই অংশ নিতে পারে। নথিতে উল্লেখ রয়েছে, ইঞ্জিন ও বডি একই ব্র্যান্ডের হতে হবে। অথচ বিশ্বের বেশির ভাগ বড় ব্র্যান্ডই (ক্যাটারপিলার ও কুমাৎসু বাদে) নিজেরা ইঞ্জিন উৎপাদন করে না; বরং তারা হিনো, ইসুজু, পারকিনস, মিৎসুবিসির মতো কোম্পানির ইঞ্জিন ব্যবহার করে।
টেন্ডারে আরও বলা হয়েছে, পণ্যটিতে অ্যাসার্ট টেকনোলজির কুলিং সিস্টেম থাকতে হবে, যা একমাত্র ক্যাটারপিলারের মডেলেই থাকে। অন্য ব্র্যান্ডগুলোর কুলিং সিস্টেম ভিন্ন হলেও তারা বিড করতে পারবে না। শর্তে আরও বলা হয়েছে, নেট পাওয়ার ১৬০ থেকে ১৭০ এইচপির মধ্যে থাকতে হবে। কোনো ব্র্যান্ডের নেট পাওয়ার ১৭০-এর বেশি হলেও তারা অংশ নিতে পারবে না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র ও ব্যবসায়ীরা জানান, যারা এই শর্তগুলো তৈরি করেছেন, তাদেরই কেউ কেউ নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগসাজশ করে শর্তগুলো বসিয়েছেন; যাতে অন্যরা স্বাভাবিকভাবেই বাদ পড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে স্বপন কুমার মৃধা নামের এক কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। তিনি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) এবং এই টেন্ডারের স্পেসিফিকেশন কমিটির সদস্য।
অভিযোগে বলা হয়, গোপালগঞ্জের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে তিনি দীর্ঘদিন ধরে এভাবে প্রভাব বিস্তার করে আসছেন। তিনি ক্যাটারপিলারের স্থানীয় এজেন্টের সঙ্গে ব্যবসায়িক অংশীদারের মতো আচরণ করছেন এবং অন্য ব্র্যান্ডের সাপ্লায়ারদের সঙ্গেও দেনদরবারে অংশ নেন।
এই অভিযোগের বিষয়ে স্বপন কুমার মৃধার বক্তব্য জানতে দুটি ফোন নম্বরে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। তার অফিস তেজগাঁওয়ের সড়ক ভবনের ১১ তলায় গিয়ে খোঁজ নিলে একজন কর্মচারী জানান, তিনি অফিসেই আছেন। প্রতিবেদককে একটি রুমে বসতে বলা হয়, কিন্তু স্বপন কুমার মৃধা না এসে পাঠান সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার সাইদুলকে। সাইদুল প্রথমে দাবি করেন, মৃধা সাহেব এই টেন্ডারে জড়িত নন। পরে জানানো হয়, তিনি স্পেসিফিকেশন কমিটির সদস্য হিসেবে স্বাক্ষর করেন এবং এ জন্য দুই হাজার টাকা সম্মানী পান। এরপর আর কোনো ভূমিকা তার নেই বলে দাবি করা হয়। যখন আবার বক্তব্য চাইলে সাইদুল জানান, তিনি এখন উপস্থিত নেই।
জানা গেছে, টেন্ডারের শর্তগুলো সংশোধনের দাবিতে একাধিক ব্র্যান্ডের স্থানীয় সরবরাহকারীরা ইতোমধ্যে অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছেন। প্রতিবেদকের হাতে সেসব চিঠির কপিও এসেছে। তবে ভবিষ্যতে হয়রানির আশঙ্কায় কেউ গণমাধ্যমে মুখ খুলতে রাজি হননি।
এ ধরনের পূর্বপরিকল্পিত ও সঙ্ঘবদ্ধ অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের ক্রয় ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সব কিছুই স্ট্যান্ডার্ড ফরম্যাটে হবে, কারও জন্য আলাদা কিছু হবে না। বাংলাদেশে দেখা যায়, যে টেন্ডার পায় না তারই অভিযোগ থাকে। আমরা বলে দিয়েছি, স্ট্যান্ডার্ড ফরম্যাটেই হবে।’
উল্লেখ্য, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনিয়মের অভিযোগে ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত সেই তালিকায় মেসার্স এএসএল ও তার স্বত্বাধিকারী আফতাব আহমেদের নামও ছিল। আফতাব আহমেদের প্রতিষ্ঠানই হলো এইচটিএমএস লিমিটেড। বাংলাদেশে ক্যাটারপিলারের মূল ডিলার হলো বাংলা ক্যাট। বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটে তাদের ভূমিকাও ব্যাপক। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গত পাঁচ বছরে বাংলা ক্যাটের পকেটে গেছে চার হাজার ৪০০ কোটি টাকা!
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটি সরকারি ক্রয় নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। উš§ুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা দরকার, যাতে সর্বনিম্ন মূল্য ও সর্বোচ্চ মানের পণ্য কেনা সম্ভব হয়। শর্তগুলো যদি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় বাধা হয়, তাহলে এটাকে ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্যমূলক বলা যায়। এ ধরনের ঘটনায় প্রকল্প বা টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কারও যোগসাজশ থাকতে পারে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে এমন অনিয়ম খুব সাধারণ হয়ে গিয়েছিল, যা এখনও চলতে থাকায় তা দুঃখজনক।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমেই এই টেন্ডার বাতিল করে নতুন করে নথি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যায়। পাশাপাশি, যারা এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’