সোহেল রানা: কিশোরদের গ্যাং সংস্কৃতি, উঠতি যুবকদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাওয়া, বখে যাওয়া তারুণ্য বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও আশঙ্কাজনক বিষয়। তরুণরা বিপথে চলে যাচ্ছে সত্যিকারের জীবনবোধের অভাবে। ফাঁকা জায়গা সহজেই যে কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করে ফেলা যায়। তাই বিভিন্ন গোষ্ঠী খুব সহজেই উঠতি তারুণ্যকে নিজেদের মতবাদে দীক্ষিত করে ফেলতে পারছে। মুক্তির উপায়? তারুণ্যকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে এমন কিছুর সঙ্গে, যা তাকে জানতে আগ্রহী করবে, শিখতে আগ্রহী করবে, বাঁচতে শেখাবে। এক জীবনেই অনেক জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়, শুধু বইয়ের মাধ্যমে। মানবমনের অবারিত মুক্তির আর কোনো সহজ পথ নেই।
অভিভাবকদের একটা অংশ চায় না তাদের সন্তানরা ক্লাসের বইয়ের বাইরের বই পড়ুক। আরেকটা অংশের গর্বিত উচ্চারণ, ‘আমাদের সন্তানরা ক্লাসের বইয়ের বাইরে বই পড়ে না!’ এখনকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ে না, খুব পরিচিত অভিযোগ। আসলেই কি তাই? যদি তা-ই হয়, সেটা নিয়ে কি কখনও আমরা সত্যিকার অর্থে কাজ করেছি? আমরা কি বোঝার চেষ্টা করেছি, কেন তারা বই পড়ছে না বা তারা কী পড়তে চায়? তাদের আগ্রহ, চাহিদা কী, কী ধরনের বই হলে তারা পড়বে এবং সেই ধরনের বই লেখা হচ্ছে কি না?
আমরা বা আমাদের আগের প্রজন্ম পড়ার বইয়ের সঙ্গে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তাম। পারিবারিক বাধা-বিপত্তিও ছিল। তারপরও পড়তাম। তাহলে হঠাৎ কী এমন হলো, একটা প্রজন্ম বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো? বর্তমান প্রজন্মের বই না পড়ার পেছনে মোবাইল ফোন আর টেলিভিশনকে দায়ী করা হয়। কিন্তু আসলেই কি তাই? যারা বই পড়ে, তারা জানে এটি সত্য নয়। হয়তো মিথ্যাও নয়, মার্কিন রাজনীতির ভাষায় ‘অল্টারনেটিভ ফ্যাক্ট’! এটি প্রতিযোগিতার যুগ, ‘সার্ভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট’-এর যুগ। মোবাইল ফোন, টিভি ভালো কনটেন্ট দিতে পারছে বলেই এগুলোর প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বেশি। ভালো বই দিতে পারলে তারা বইও পড়বে। সত্যিই পড়বে।
বইমেলায় সেবা প্রকাশনীর স্টলের সামনে ভিড় থাকে সবচেয়ে বেশি। একেবারে শিশু-কিশোররা ব্যাগ ভরে বই কিনে নিয়ে যাচ্ছে! এদের দেখলেই এখনকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ে না অভিযোগ ধোপে টিকবে না। সমস্যা হচ্ছে, এই ছোট শিশুরা যখন বড় হয়ে উঠছে, তারা আর বয়স উপযোগী বই পাচ্ছে না। আমাদের শৈশব-কৈশোরের নায়ক তিন গোয়েন্দার কিশোর-মুসা-রবিন তাদের দুনিয়াও রাঙিয়ে দেয়। তারপর জাফর ইকবাল, সুমন্ত আসলামের মতো কয়েকজনের চেষ্টা। তারপরই এক বিশাল শূন্যতা।
শরৎ, বিভূতি, মানিক পড়া শুরু করার আগে পাঠক হিসেবে পরিপক্ব হয়ে ওঠার যে সময়টা সেই জায়গায় যে শূন্যতা, সেটি পূরণের জন্য কোনো লেখক তৈরি হচ্ছে না। অথবা লেখক হয়তো তৈরি হচ্ছে, তারা প্রচারের আলোয় আসছে না। শিক্ষিত ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সের এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যে, হুমায়ূন আহমেদ বা ইমদাদুল হক মিলনের বই পড়েননি। কিন্তু এর পরবর্তী প্রজন্মের একজন লেখকের নাম বলতে পারবেন তাদের সংখ্যা হাতেগোনা।
একজন লেখক কীভাবে লেখক হয়ে ওঠে? তিনি পরিচিত হন কীভাবে? তার জন্য প্রয়োজন জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকা। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে উতরে যাওয়া সাহিত্য পত্রিকার অভাব আজ খুব বেশি স্পষ্ট। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজনের হাতে এখন সাহিত্য পত্রিকা পৌঁছায়? আমার অন্তত কারও হাতে চোখে পড়েনি!
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট নিজেরাও সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করতে পারে। যদিও সে ধরনের প্রচেষ্টা খুব একটা দেখা যায় না। একসময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় দেয়াল পত্রিকা হতো, এখন কি হয়? স্কুল-কলেজের পত্রিকা বা দেয়াল পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হওয়া একজন উঠতি লেখকের জন্য এক বিরাট অনুপ্রেরণা। এগুলো যেমন লিখতে অনুপ্রাণিত করে, তেমনি অনুপ্রাণিত করে ভালো লেখা পড়তেও।
আসলে এখন অধিকাংশ স্কুল-কলেজে এসব ‘ফালতু’ লেখালেখি, ‘আউট’ বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার সময় নেই! তার জন্য দায় আমাদের অভিভাবকদেরও কম নয়। বড় সংখ্যক অভিভাবক মনে করেন, বাইরের বই পড়লে ‘আসল’ পড়ালেখায় ক্ষতি হয়! সবাই এ প্লাস, গোল্ডেন এ প্লাসের মতো পরশ পাথরের পেছনে ছুটতে ব্যস্ত! অন্য বই পড়ে সময় নষ্ট করলে ‘সৃজনশীল’ প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে আসার মতো অদ্ভুত সৃজনশীলতা বাধা প্রাপ্ত হতে পারে!
একটা সময় ছিল যখন যে রাঁধতো, সে চুলও বাঁধতো। এখন আর সেই দিন নেই! এখন যে রাঁধে তার চুল বাঁধা বারণ! কারণ চুল বাঁধতে গেলে যদি রান্নায় ‘এ প্লাস’ মিস হয়ে যায়! তাই এখনকার মেধাবীদের ক্লাসের বই ছাড়া অন্য বই পড়া মানা। ‘তুমি যদি বিরল বুদ্ধিসম্পন্ন কারও সামনে পড়ো, তাকে জিজ্ঞেস করো সে কোন বই পড়েছে! (র্যালফ ওয়ালডো এমারসন)। বই পড়ার সুযোগ বন্ধ করে আমরা কি আমাদের সন্তানদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করছি না? ‘যখন তুমি একটি ভালো বই পড়ো, পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আলোকোজ্জ্বল একটি দরজা খুলে যায়! (ভেরা নাজারিয়ান)। আমরা কি আমাদের সন্তানদের সেই আলো থেকে বঞ্চিত করছি! বন্ধ করে দিচ্ছি রাস্তাগুলো?
একটা কৌতুক শুনেছিলাম। এক লোককে জিজ্ঞাস করা হলো, তার প্রিয় বইয়ের নাম কী? তিনি অনেক চেষ্টা করেও কোনো বইয়ের নাম মনে করতে না পেরে হেসে বললেন, ‘চেকবই ছাড়া তো কোনো বইয়ের নাম মনে পড়ছে না!’ আচ্ছা, এটা কি শুধুই কৌতুক? আমাদের আশপাশে কি আসলেই এরকম লোক নেই!
দুষ্টু লোকরা বলে, বইমেলায় বিক্রি হওয়া অনেক বই-ই কখনও পড়া হয় না। সবাই স্ট্যাটাস বাঁচাতে ব্যস্ত। বইমেলায় না গেলে, বই না কিনলে স্ট্যাটাস থাকে না। ঘরে বই না থাকলে ঘর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তাই অনেকেই বই কিনে শেলফ ভরে ড্রইং রুমে রেখে দেন। দুঃখজনক হচ্ছে, অনেকের ড্রইং রুমে সাজানো বইয়ের পরিপাট্য দেখলেই বোঝা যায়, বইগুলো কখনও খোলা হয়নি! তবে আশা করতে ইচ্ছে করে, আজ যারা বুঝতে পারছে বই ছাড়া ঘর ফাঁকা ফাঁকা লাগে, তারা ঠিকই একদিন বুঝে ফেলবে বই ছাড়া মানুষের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকাই থাকে!
জাফর ইকবালের প্রকাশিত শেষ সায়েন্স ফিকশনটাও যদি এরই মধ্যে আপনার সন্তানের পড়া হয়ে থাকে তাহলে ‘ওরা বই পড়ে না’ কথাটি কি আদৌ সত্যি? সত্যিটা হচ্ছে পাঠক প্রস্তুত, লেখকও আছে, প্রকাশকেরও অভাব হওয়ার কথা নয়। অভাব শুধু সমন্বয়হীনতা। বইমেলায় দর্শকের অভাব নেই। এই বিপুল দর্শককে পাঠকে রূপান্তর করা খুব কঠিন কাজ নয়। হুমায়ূন আহমেদ করে দেখিয়েছেন। সবাই হুমায়ূন আহমেদ নন, কিন্তু ভালো লেখেন তাদের সংখ্যাও কিন্তু খুব কম নয়। প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে নতুন প্রতিভাবান লেখকদের জন্য জায়গা করে দিতে হবে, করতে হবে সঠিক প্রচারণার ব্যবস্থা। লেখকরা প্রচারবিমুখ হয়। শ্রীকান্ত লেখার পর শরৎচন্দ্র পাণ্ডুলিপি তালা মেরে রেখেছিল এই ভয়ে যে, ‘এ লেখা কে পড়বে?’। তাই প্রকাশকদের দায়িত্ব নিতে হবে লেখক তুলে আনার। কে বলতে পারে, কার তালা মারা বাক্সের ভেতর থেকে শ্রীকান্ত’র মতো অমর সৃষ্টি বের হয়ে আসবে!
নতুন লেখক তৈরিতে যেখানে প্রকাশকদের সহযোগিতা প্রয়োজন, উল্টো সেখানে প্রকাশকদের বিরুদ্ধে নতুন লেখকদের অভিযোগ শোনা যায়। বইমেলার আগে বই প্রকাশের জন্য নতুন লেখকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই প্রকাশ না করা অথবা যেনতেনভাবে প্রকাশ করার অভিযোগ নতুন নয়। বাজে কাগজে মানহীন বই একজন নতুন লেখককে শুধু হতাশই করে না, এটা তার ভবিষ্যৎ সৃষ্টির আগ্রহকেও নষ্ট করে দেয়।
পাঠক সৃষ্টির জন্য বইয়ের দামের দিকে লক্ষ্য রাখাও জরুরি। ১৫০ পৃষ্ঠার একটি বই ২৫০ বা ৩০০ টাকা দিয়ে কেনা ঢাকা বা বিভাগীয় শহরের ছেলেমেয়েদের কাছে হয়তো কঠিন নয়, কিন্তু উপশহর বা উপজেলা পর্যায়ের ছেলেমেয়েদের জন্য খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। গ্রামের ছেলেমেয়েরাও পড়তে চায়, তাদের আগ্রহ শহরের ছেলেমেয়েদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু বইয়ের দাম অনেক সময়ই নাগালের বাইরে থেকে যায়। আরেকটি দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার, বেশিরভাগ উপজেলা শহরেই বইয়ের দোকানে গল্প-উপন্যাসের বই কিনতে পাওয়া যায় না! আমরা জনসংখ্যার একটি বড় অংশকেই সাহিত্যের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যর্থ হচ্ছি।
দায়িত্ব আছে আমাদেরও। বই কিনতে হবে। নিজেদেরও বই পড়তে হবে। আমাদের দেখেই না আমাদের সন্তান বই পড়া শিখবে! প্রত্যেকের ঘরে ছোটখাটো লাইব্রেরির মতো করে ফেলতে হবে। মা-বাবা, চাচা-মামাদের পড়তে দেখে যে শিশুরা বড় হয়, তাদের বই না পড়ার কোনো কারণ নেই। ‘অনেক ছোট ছোট পথ আছে তোমার শিশুর পৃথিবীকে বড় করে দেওয়ার। সেগুলোর ভেতর সবচেয়ে ভালো পথ বইয়ের প্রতি ভালোবাসা (জ্যাকুলিন কেনেডি ওনাসিস)।’
দেখতে ভালো লাগে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কি এক দুর্বার বাঁধনে বই আর মানুষকে বেঁধে চলেছে! তৈরি করে চলেছে ‘আলোকিত মানুষ’। মানুষ বই কিনছে, বই পড়ছে, প্রিয়জনকে বই কিনে দিচ্ছে! বইয়ের চেয়ে ভালো সঙ্গী আর কী হতে পারে! বইমেলা গেলেই আমি সেবা’র স্টলে ঢুঁ দিই। ছোট ছেলেমেয়েদের হাতভরা বই আর মুখভরা অপার্থিব হাসি দেখে মনে হয় আশা আছে! আশা আছে!
ফিন্যান্স অ্যান্ড ট্যাক্স কোঅর্ডিনেটর
স্পাই অয়েল অ্যান্ড গ্যাস সার্ভিসেস
(থাইল্যান্ড) লিমিটেড
sohelrana.iba@gmail.com