কাজী সালমা সুলতানা: ‘প্রথমে একটা চাকা গেছে, ওরা গাড়িটা থামায় নাই, তখনও আমি পইড়া রইচি। আরেকটা চাকা আমার পায়ের উপর দিয়া চইলা গ্যালো, তহন আমার পাডা আলাদা হয়ে গ্যালো।’ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কথাগুলো বলছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোজিনা। তখনও তিনি জানতেন না যে, একটি পা নয়, এর মাধ্যমে দুনিয়া থেকেই তার বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে। এক পা হারিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালেই রোজিনার মৃত্যু হয়।
গত ২০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টায় রাজধানীর চেয়ারম্যান বাড়ির কাছে রাস্তা পার হতে গিয়ে বিআরটিসি বাসের চাকায় একটি পা হারান গৃহকর্মী রোজিনা। ২৯ এপ্রিল তিনি মারা যান। একই দিনে ধানমন্ডিতে ট্রাকের চাপায় রিকশারোহী মাসুদা (৩৬) আহত হন। ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কাছে দুই বাসের রেষারেষিতে একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ এপ্রিল মারা যান তিনি। ১৮ এপ্রিল গুলিস্তানে বাসের চাকায় ব্যবসায়ী আওলাদ হোসেনের পায়ের পাতা ও চার আঙুল থেঁতলে যায়। ২৮ এপ্রিল যাত্রাবাড়ীতে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে মাইক্রোবাসের চালকের পায়ের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে দেয় গ্রিন লাইন পরিবহনের বাসচালক। তার একটি পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে দুই বাসের বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় নির্মম মৃত্যুর শিকার হন ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন। মাত্র তিন দিন আগে তিনি সন্তানের বাবা হয়েছেন। তার স্ত্রী এখনও অসুস্থ।
রোজিনার জীবন থেমে যাওয়ার মাধ্যমে রুদ্ধ হয়ে গেল তার মা-বাবার স্বাভাবিক জীবন। মানুষের বাসায় কাজ করে রোজিনা টাকা পাঠাতেন মা-বাবাকে। তা দিয়ে চলত মা-বাবার সংসার। পিতামাতাহীন রাজীব টিউশনি করে নিজে পড়াশোনা করতেন, ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচও চলত তার উপার্জনে। রাজীবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেছে তার ছোট দুই ভাইয়ের জীবন। নতুনভাবে তাদের চিন্তা করতে হবে বেঁচে থাকার জন্য। মাইক্রেবাস চালকেরও পরিবার রয়েছে, যারা তার ওপর নির্ভরশীল। নি¤œআয়ের মানুষদেরই গণপরিবহনে চলাফেরা করতে হয়। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার শিকারও তারাই বেশি হন। আর উপার্জনশীল এসব মানুষের এমন দুর্ঘটনায় মুত্যু বা আহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুরো পরিবারের ওপর নেমে আসে অনিশ্চিত জীবন।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে জানানো হয়েছে, এ বছরের প্রথম চার মাসে এক হাজার ৮৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় দুই হাজার ১৭৩ জন নিহত ও পাঁচ হাজার ৫৫৮ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৪৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৪ জন নিহত ও এক হাজার ৩৫২ জন আহত; ফেব্রুয়ারিতে ৪৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৫২১ জন আহত ও ৪৫৯ জন নিহত; মার্চে মাসে ৪৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৫০৬ জন আহত ও ৪৮৩ জন নিহত হয়। আর এপ্রিলে ৪৪২টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৭৮ জন আহত ও
৪৬১ জন নিহত হয়।
প্রশ্ন হলো কেন এত দুর্ঘটনা, এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কে ‘দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি? গাড়ি চালক? বিআরটিএ, যারা অনিয়মের মাধ্যমে যাকে ইচ্ছা গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দিচ্ছে? ট্রাফিক ব্যবস্থা? পুরো গণপরিবহন ব্যবস্থা নাকি আইনের অপব্যবহার?’ এমন হাজারো প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। রোজিনা রাস্তা পার হচ্ছিল। রাজীব যাত্রীভর্তি গাড়ি থেকে নামছিল হাতটা ছিল বাইরে। একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে অতিক্রম করার সময় রাজীবের একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মাইক্রোবাস চালক তার গাড়িতে আঘাত করায় বাসচালকের কাছে কৈফিয়ত চাচ্ছিলেন, যা সচরাচর ঘটে। তাহলে তাদের জীবনে এমন দুর্ঘটনা নেমে আসার জন্য দায়ী কে?
ঢাকা শহরে যেসব গাড়ি গণপরিবহনে রয়েছে, আদৌ কি তা রাস্তায় চলার উপযোগী? অনেক গাড়ির বাইরের অবস্থা দেখেই গা ঘিনঘিন করে। ভেতরের সিট, দুই সিটের মাঝের ফাঁকা স্থানের পরিমাণ, গাড়ির বডি, জানালার কাচ, রংÑএসব দেখলে বুঝতে মোটেও সমস্যা হয় না যে, এ গাড়ি রাস্তায় চলাচলের উপযোগী নয়। বিশ্বের কোনো দেশের রাজধানী শহরে এমন বিবর্ণ, জোড়াতালি দেওয়া, ভাঙাচোরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করে না। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে নির্বিঘেœ চলছে এসব গাড়ি। ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ি নাকি পুলিশকে মাসোয়ারা দিয়ে চালানো হয়। এসব গাড়ির চালকের স্বেচ্ছাচারিতায় ট্রাফিক পুলিশটিকেও জীবন হারাতে হয়।
একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এসব গণপরিবহনের চালকের আসনে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে কোনো কিশোর। এ বয়সে গাড়িচালকের লাইসেন্স তার পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু পেয়ে গেছে। অথবা ওই কিশোর গাড়ির হেলপার, কোনো লাইসেন্সই নেই। প্রকৃত চালক বিশ্রাম নিচ্ছে, এ ফাঁকে সে একটা ট্রিপ চালাচ্ছে। আবার গাড়িচালকদের অনেকেই মাদকসেবী। নিজেদের শরীরের ওপরই এদের নিয়ন্ত্রণ নেই। জানা যায়, দেশে বৈধ যানবাহন ১৩ লাখের বেশি। আর বৈধ চালকের সংখ্যা মাত্র আট লাখ। লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ অবৈধ কত চালক গাড়ি চালায়, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। এসব চালকের হাতে যাত্রী বা পথচারীর জীবন বিপন্ন হচ্ছে। অধিক মুনাফার লোভে চালকেরা পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ফলে ওভারটেকিং করে নিয়ম-কানুনকে তোয়াক্কা না করে। আর এর ফল হিসেবে বাসযাত্রীদের জীবন বিপন্ন হয়।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ঢাকা মহানগরীতে নির্ধারিত স্থানের বাইরে গাড়ি থামত না। অর্থাৎ যাত্রীদের বাসস্ট্যান্ড থেকে উঠতে হতো এবং বাসস্ট্যান্ডেই নামতে হতো। কিন্তু এখন ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা দেখে মনে হয়, পুরো ঢাকা শহরই যেন বাসস্ট্যান্ড। যেখানে যাত্রী পাচ্ছে, সেখান থেকেই তুলছে। আবার যেখানে যাত্রীর ইচ্ছা, সেখানেই নামিয়ে দিচ্ছে। এজন্য ওই গাড়িটি রাস্তার পাশেও চাপানো হচ্ছে না। রাস্তার মাঝখানেই যাত্রী ওঠানো বা নামানো হচ্ছে। এভাবে যাত্রী ওঠানো-নামানো যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা গাড়িচালক, গাড়ির হেলপার এমনকি ওই যাত্রীরও ধারণা নেই। এছাড়া এভাবে যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করানোর ফলে তার পেছনে যে অসংখ্য গাড়ি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, সেদিকেও ভ্রুক্ষেপ নেই গাড়িচালকের। রাস্তার মধ্যে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানোর পর যেকোনো সময় পিছন থেকে আসা আরেকটি বাসের নিচে জীবন চলে যাচ্ছে যাত্রীর।
একই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারীদের অসতর্কতাকেও দায়ী মনে করা হয়। সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে গাড়িচালক ও পথচারীর অসতর্কতা ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ৭২ শতাংশই পথচারী। সারা দেশে যত দুর্ঘটনা ঘটে, তার জন্য পথচারীরাও অনেকাংশে দায়ী। পথচারীরা যদি সতর্কতার সঙ্গে রাস্তা পার হয়, তাহলে প্রাণহানির সংখ্যা কমে আসবে। যানবাহনে অতিরিক্ত যাত্রী হওয়া, ট্রাকে যাত্রী হওয়া, ট্রাকের পণ্যের ওপর যাত্রী হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেছেন, রাস্তার ওপর ফেরিওয়ালা ও বেচাকেনাও পথচারীদের ঝুঁকির অন্যতম কারণ। পর্যাপ্ত ফুটপাত নির্মাণ, গণপরিবহনের সুব্যবস্থাপনা করাসহ সরকারের সদিচ্ছ্ই পারে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে।
প্রতিদিন সড়কে যাতায়াত যেন জীবন-মৃত্যুর সংগ্রাম। দেশের জনগণ যেন পরিবহন মালিকের হাতে জিম্মি। চালকের স্বেচ্ছাচারিতা, যখন-তখন ওভারটেক করা, অতিরিক্ত জোরে গাড়ি চালানোয় পথচারীর মৃত্যু হলে চালকের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। একজন অপরাধীর পক্ষ নিয়ে দেশব্যাপী পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়ে যায়। এ অবস্থার নিরসন হওয়া দরকার। সরকারের পাশাপাশি পথচারী ট্রাফিক পুলিশ, পরিবহন মালিক ও চালকের দায়িত্ববোধ ও আন্তরিক সচেতনতার সমন্বয়ই পারে সড়ক দুর্ঘটনা সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনতে।
গণমাধ্যমকর্মী