পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে কক্সবাজার ঘিরে মহাপরিকল্পনা

আবুল কাসেম হায়দার: বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প একটি সম্ভাবনাময় বড় খাত। দীর্ঘদিন ধরে এই খাতে আশানুরূপ সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ দেখা যায়নি। বিদেশি বিনিয়োগ নেই বললে চলে। কিন্তু বিদেশি বড় বিনিয়োগ ছাড়া পর্যটন খাতকে কেন বিদেশিদের মধ্যে আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে শুধু বিদেশি আকর্ষণীয় বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে জমজমাট ব্যবসা চলেছে। আমাদেরও অনুরূপ চিন্তাভাবনা করতে হবে। বাংলাদেশের পর্যটনের রাজধানী হিসেবে ইতোমধ্যে কক্সবাজার ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। এখানে বিশেষ করে ছুটির দিনে এত বেশি পর্যটকের আগমন ঘটে যে, হোটেল-মোটেলগুলোয় ঠাঁই হয় না। এ কারণে এখানে অবকাঠামোগত ব্যবস্থার আরও উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের জন্য কক্সবাজার ও এর আশেপাশের এলাকাকে আরও আকর্ষণীয় হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। এ লক্ষ্যে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোয় প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে এক লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটেল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা, ইনানি সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরায়েং ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শ্যামলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণ, চকোরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের আধুনিকায়নসহ ২৫ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এছাড়া আরও চারটি নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে আরও কয়েকটি প্রকল্প। এসব বাস্তবায়িত হলে আগামীতে দেশের পর্যটন খাত আরও চাঙা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও পিপিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কক্সবাজারে যাতায়াত করার জন্য রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে। এই লাইন আরও সংস্কার করা হচ্ছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। এ খাতে বিনিয়োগ হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কক্সবাজারে আরও দুটি মোটেল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিমান-নৌবাহিনীর উদ্যোগে সেখানে একটি বড় গেস্ট হাউজ নির্মিত হচ্ছে। রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। সেগুলোকে সংস্কার করে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ খাতে প্রায় ৩৩৫ কোটি টাকা খরচ করা হবে। রামু ক্যান্টনমেন্ট নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। একে কেন্দ্র করেও আশেপাশে নানা অবকাঠামো গড়ে উঠছে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ হয়ে শাহপরীর দ্বীপের চার পাশে বেড়িবাঁধ নির্মিত হচ্ছে। এটিকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কক্সবাজার থেকে শ্যামলাপুর পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মিত হয়েছে। এখন বাকিটুকুর কাজ চলছে। শাহপরীর দ্বীপের নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গড়ে উঠেছে বিশাল চর। এখানে থেকে যেমন সেন্টমার্টিন দ্বীপকে দেখা যায়, তেমনি সাগর-নদীর পানির মিলনস্থলের পার্থক্য বুঝা যায় পরিষ্কারভাবে। এগুলো পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে সেখানেও একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
টেকনাফের সাবরাং এলাকায় তৈরি হচ্ছে ইকো ট্যুরিজম পার্ক। নাফ নদীর মাঝে একটি চরকে গড়ে তোলা হচ্ছে পর্যটন এলাকা হিসেবে। কক্সবাজারের ঝিলংঝার নাজিরের টেক এলাকায় সৈকতের উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ (দ্বিতীয় পর্যায়) নামের একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে তিন হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পেলে আগামী ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
মহেশখালীকে পাওয়ার হাব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। শুধু মহেশখালীতেই বিনিয়োগ হচ্ছে লাখ কোটি টাকা। সোনাদিয়া দ্বীপে অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কুতুবদিয়া দ্বীপে বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। এটি দেখতে অনেক পর্যটক সেখানে যান। এ কারণে একে আরও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, কক্সবাজার ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) বাস্তবায়নের জন্য সাতটি প্রকল্প নির্ধারিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর ও বন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় পর্যটনশিল্পের বিকাশ প্রকল্প। এছাড়া খুলনায় আন্তর্জাতিক মানের হোটেল কাম ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ, মংলায় থ্রি স্টার মানের হোটেল, কক্সবাজারের মোটেল উপল কম্পাউন্ডে আন্তর্জাতিক মানের ট্যুরিজম কমপ্লেক্স, সিলেটে বিদ্যমান পর্যটন করপোরেশেন মোটেল কম্পাউন্ডে পাঁচ তারকা হোটেল, কক্সবাজারে এন্টারটেইনমেন্ট ভিলেজ ও পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স তৈরি এবং খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে যারা টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে যাবেন তাদের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করতে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। সুন্দরবনকে ঘিরে একটি স্টাডি প্রকল্পও নেওয়া হবে। এ রকম নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিপিপির আওতায় প্রকল্পগুলো প্রক্রিয়াকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। পর্যটন সুবিধাদি বাড়ানোর জন্য চলমান কয়েকটি প্রকল্প হচ্ছে চট্টগ্রামের পারকিতে পর্যটন সুবিধাদি প্রবর্তন, পর্যটন বর্ষ উপলক্ষে দেশের কিছু পর্যটন আকর্ষণীয় এলাকায় পর্যটন সুবিধার উন্নয়ন, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পর্যটন ভবন নির্মাণ, জাতীয় ট্রেনিং অ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত সোনামসজিদ পর্যটন মোটেলের সংস্কার প্রকল্প অন্যতম।
যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন
এক. দেশে পর্যটনশিল্পকে বড় শিল্প খাত হিসেবে দাঁড় করাতে হলে দীর্ঘমেয়াদি ও বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। উন্নতমানের আকর্ষণীয় ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারলে বিদেশি পর্যটক আমাদের দেশে প্রচুর আসবে। কেন পর্যটক, সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সবচেয়ে বড়। দ্বিতীয়ত: আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। বিনোদনের সুন্দর ও নতুন নতুন আইটেম। অনুরূপ আকর্ষণীয় বিনোদনমূলক পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে পর্যটক আসবে।
দুই. পর্যটনের জন্য আমাদের দেশের অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত রাস্তা, হোটেল, মোটেল ও বিমানবন্দর সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরগুলোতে যানবাহন বিরাট সমস্যা। কোনো বিদেশি পর্যটক ঢাকা শহরে এলে আমাদের যানজটের কারণে অবস্থা যে কোনো পর্যটককে হতাশ করে এই অবস্থার উন্নতির জন্য সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ঢাকা শহরে মেট্রো রেল নির্মাণ একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ।
তিন. সড়ক পরিবহন অবস্থা আমাদের দেশে বেহাল অবস্থায় রয়েছে। কিছু দিন আগে স্কুলের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন করে দেখিয়েছে, আমাদের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় সমস্যা কোথায়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, সরকারকে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু ফলাফল তেমন উল্লেখযোগ্য চোখে পড়ে না। পর্যটনশিল্পের স্বার্থে নিরাপদ সড়ক জরুরি।
চার. সরকার সুন্দর সুন্দর প্রকল্প হাতে নিয়েছে, কিন্তু মানসম্মত প্রকল্প বাস্তবায়ন এই ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে সরকারই কাজকে তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে মানসম্মত নির্মাণে কাজ সমাধা করা হচ্ছে না। তাই দেখা যায় কয়েক মাসের মধ্যে তৈরি রাস্তা, ব্রিজ, বিল্ডিং ভেঙে যায় বা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থাপনা নির্মাণ করা হয় দীর্ঘমেয়াদ পর্যন্ত চলার উপযোগী করে। আজ থেকে ২৫০ বছর পূর্বে পাতাল ট্রেন তৈরি করে বিলেতে। আজও কাজ করছে। যারা বিলেতে গিয়েছেন তারা তাদের পাতাল ট্রেনে ভ্রমণ নিশ্চয় করেছেন। এই জন্য সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীর প্রয়োজন। কমিশন বাণিজ্য করে কোনো স্থাপনা তৈরি করলে তা গুণগতমান সম্পন্ন হয় না।
পাঁচ. পর্যটনশিল্প বাংলাদেশে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশের মানুষও দেশকে দেখতে চায়, বেড়াতে চায়; অবসর সময় বিভিন্ন জেলায় বেড়ানোর বেশ অভ্যাস গড়ে উঠেছে। এজন্য বিভিন্ন জেলায় বিনোদন ও থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা থাকলে পর্যটনশিল্প প্রসার লাভ করবে। আর বিদেশিদের জন্য দরকার নিরাপদ সড়ক, সুন্দর থাকা-খাওয়ার হোটেল-মোটেল। আমাদের দেশ সবুজ। সবুজকে সবাই ভালোবাসে। এই সবুজের সঙ্গে কিন্তু বিনোদন যোগ করতে পারলে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে। সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো পর্যটনশিল্পের সূতিকাগার কক্সবাজারসহ সারা দেশে কিছু কিছু অংশে বেশ উন্নয়ন ঘটবে।

সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ বিজিএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড