সেলিন সুই: চীন যখন ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলোতে প্রবেশ করে, তখন প্রথমেই তারা বুঝতে পারে, তাদের কেবল শ্রমবিতর্কই মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আর তাই তারা আইন ও সাংস্কৃতিক সংকটের পেছনে হন্যে হয়ে ছুটতে থাকে। পত্রিকার শিরোনাম যাই হোক না কেন তাদের সংকটগুলোর সঙ্গে আপস করেই চলতে হয়।
বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনার আওতায় চীন আফ্রিকায় সরাসরি বিনিয়োগ করে চলেছে। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৩ সালে একটি বক্তব্য পেশ করেন। বেল্ট ও রোড নিয়ে অহরহ প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এসব প্রতিবেদনে চীনা বিনিয়োগ এবং এই বিনিয়োগে বিদেশিদের প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো শ্রমবিতর্কের ভিত্তিতে বাণিজ্যকৌশলকে সংজ্ঞায়িত করেছে।
আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগে একেবারে পুরোভাগ জুড়ে রয়েছে ইথিওপিয়া। এটা আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তর বাজার, যেখানে ১০০ মিলিয়ন মানুষ সম্পৃক্ত রয়েছে। এখানে রয়েছে চীনের নিম্ন শ্রমব্যয় ও বিশালায়তনের ভোগ্য বাজার, যা চীনের কোম্পানিগুলোর জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত করেছে। ২০১৮ সালে এই দেশে ৪০০ সক্রিয় চীনা বিনিয়োগী প্রকল্প স্থান পায়, যার সমুদয় মূল্যমান ছিল চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বেশিরভাগ চীনা প্রতিষ্ঠান আফ্রিকায় তাদের বাণিজ্য কার্যক্রম পারিচালনা করে যাচ্ছে। আর এসব কোম্পানির বেশিরভাগই বেসরকারি মালিকানাধীন। জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হুয়াজিয়ান গ্রুপের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের মতো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান উভয়ই আবার তাদের কাজের প্রয়োজনে ইথিওপীয় জনশক্তিকে নিয়োগ দিচ্ছে।
যে স্থানে আঞ্চলিক কর্মী কাজ করে, সেখানে বেশি শ্রম বিতর্ক থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ২০১৭ সাল থেকে কমপক্ষে ডজনখানেক ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল এবং পুরো কারখানা এলাকায় এসব ধর্মঘট পালিত হয়েছে। এখানে হাজার হাজার কর্মী যোগ দেয়। চীনা ম্যানেজারেরা এসব শ্রমবিতর্ক নিয়ে গভীরভাবে মোকাবিলা করতে বাধ্য হয়েছেন। তারা যেমন এ সংকট কোম্পানির মধ্য থেকে মোকাবিলা করতে বাধ্য হয়েছেন, তেমনি তারা আদালতেও এ নিয়ে সংগ্রাম চালিয়েছেন। একটি আইন-বিচারসংক্রান্ত কাঠামোর মধ্য থেকে এটা কখনও কখনও আঞ্চলিক কর্মীদের পক্ষে আবার কখনও কখনও বিদেশি কর্মীদের পক্ষে মোড় নিয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালে ইথিওপিয়ার ৬৯টি চীনা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তদন্ত চালিয়েছে। এই তদন্তে তারা সেখানকার বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে জরিপ করেছে। এই বিদেশি বিনিয়োগ বিষয়ের মধ্যে স্থান পেয়েছে অবকাঠামো, বিক্রয় ও বিপণন, জমি, অর্থায়ন ও মানবসম্পদ। আদালত ব্যবস্থা যে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে সেখানে কাজ করছে, তা ৬৫ শতাংশ উত্তরদাতা মানেননি। আবার ৭৪ শতাংশ উত্তরাদাতা মনে করেন আইন ও প্রবিধানের মাধ্যমে এসব কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে সরকারি দফতর থেকে যে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, তা সঠিক নয়।
আজ (১৯ এপ্রিল ২০১৯) ফেডারেল ফার্স্ট ইনস্ট্যান্স কোর্টে এক হাজার ৭০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের যে শ্রমবিতর্কের কথা শোনা যাচ্ছে, সেখানে বিচারকেরা যে কোনো উপায়েই হোক কর্মচারীদের পক্ষ অবলম্বনের প্রবণতা দেখাচ্ছেন। চীনা কোম্পানিগুলো ইদানীং ছোট ছোট মামলার প্রতি ক্রমেই অনাগ্রহ দেখিয়ে চলেছে।
‘তারা আপনাদের প্রশ্ন করেছে এবং যখন তারা পরিধির বাইরে কোনোকিছু ধরে ফেলেছে, তখনই তারা আপনাদের ওপরেই শাসনের ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, যখনই তারা আপনাদের কারও সই নিয়ে নিতে পেরেছে, তখনই তারা এই শাসনের ছড়ি হাতে পেয়ে গেছে। ইথিওপিয়ার সিএসসিইসি’র এক আইনসংক্রান্ত ব্যবস্থাপক এই মন্তব্য করেন। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কোনো কোনো সময় কোনো কোনো অন্যায্য রায় আদালত পুনর্বার বিবেচনা করেন এবং পাল্টে দেন। কিন্তু যখন কোনো ছোট খাট মামলায় অনেক বেশি পরিমাণে অর্থ ঢালা হয়ে থাকে, তখন সেই মামলার কোনো রায়কে নতুন করে মূল্যায়ন করে নেওয়া খুবই দুরূহ হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়াটি খুবই সময়সাপেক্ষ। এমনকি অনেক কোম্পানি এসব খাতে অনেক বেশি অর্থ ঢালতে থাকে।
তাছাড়া আদালত শ্রম ও ব্যবস্থাপনার মাঝে একটি দ্বন্দ্ব বাধিয়ে রাখে। চীনা কোম্পানিগুলো নিজেরাই আইনসংক্রান্ত বিষয়ে বেশ তৎপর ও সজাগ থাকে। ‘ইথিওপিয়া শ্রম আইনকে বেশ জটিল করে তুলেছে। ফলে নতুন যারা এই পরিসরে প্রবেশ করছেন, তারা প্রথমেই এই কঠিন পরিস্থিতিতে আঘাত পাচ্ছেন।’ আদ্দিস আবাবার সিএসইসি নির্মাণ প্রকল্পের এক প্রকৌশলী এই মন্তব্য করেন। কোম্পানিগুলো তাদের অশান্তির কথা জানিয়েছে। তারা দাবি করছে, কর্ম থেকে বরখাস্ত করার বিষয়ে ইথিওপিয়া সরকার প্রবিধানকে যেভাবে কঠিন করে তুলেছে, তাতে তাদের হাত বেঁধে ফেলা হয়েছে। ফলে তারা অসন্তুষ্ট কর্মজীবীদের দ্বারা প্রায়ই আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে।
কাজেই কোম্পানিগুলো কখনও কখনও বিধিবদ্ধ উপায়েই নরকের দুয়ারে বা প্রান্তরে গিয়ে ঠেকছে। তারা এমন সব অনিশ্চয়তার গর্তে আটকা পড়ছে যেন কী করতে হবে তার কিছ্ইু তাদের জানা নেই। এটা বিশেষ করে বহু ধাপের নির্মাণ প্রকল্পের জন্য খুবই জটিল দশা। সরকারের ঘোষণাপত্রে কর্মচারীদেরই ব্যাপকভাবে সমর্থন করা হচ্ছেÑএই জায়গা থেকে ইথিওপিয়ার দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানি প্রতিবাদ শুরু করে দিয়েছে।
এই প্রতিবাদে ইথিওপিয়া সরকার সাড়া দিয়েয়েছ। সরকার এখন এই আইনকে সংস্কার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকার এখন কর্মীদের নিয়োগের পর তাদের শিক্ষানবিশকাল (প্রবেশনারি) দ্বিগুণ করছে, বার্ষিক ছুটিতে মাথা মুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি কর্মীরা যদি নিয়মিত দেরি করে কাজে আসে, তবে কোম্পানি ওই কর্মীর চাকরি বাতিল করার ক্ষমতা পাবে।
এরই মধ্যে চীনা কোম্পানিগুলো মাইরিয়াদের প্রচলিত শ্রম পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিএসইসি ছোট ছোট দলে কর্মীদের বিভক্ত করছে। ঘোষণা কমিটিকে এ নিয়ে নিয়মিত ওয়াকিফহাল করছে। তাতে করে সহজেই তারা বিভিন্ন কর্মচারীকে বাগে আনতে পারছে, আবার তাদের ক্ষোভ মেটাতে পারছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তাতে করে দ্বন্দ্ব শেষ হবে না। নিয়মিতই তা বাড়তে থাকবে। মামলার পথই একমাত্র বিকল্প পথ হিসেবে খোলা থাকবে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের খাতিরে এই ঝুঁকিটি প্রায়ই নিরাপত্তা ও আর্থিক সংকট রূপে বিবেচিত হবে। কিন্তু আফ্রিকার মাটিতে চীনা কোম্পানির সামনে ধেয়ে আসা এসব সংকটগুলো সাপে বর হয়ে দেখা দিচ্ছে। তাদের সামনে এখন ট্রিলিয়ন ডলারের প্রকল্প উম্মুক্ত হচ্ছে। তবে আফ্রিকার কর্মচারীদের নিয়োগ দিয়ে চীনা কোম্পানিগুলো স্থানীয় লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে এবং সাংস্কৃতিক জটিলতায় নিজেদের প্রতিরক্ষা দেওয়ালকে নড়বড়ে করে ফেলেছে। যখনই চীনা কোম্পানিগুলো আফ্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে নিবিড়ভাবে শিখতে শুরু করে, তখনই বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনার পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। আর এই পরীক্ষায় তারা কেবল নিরাপত্তা ও অর্থায়নের প্রশ্নেরই সম্মুখীন হয় না, বরং তারা নিত্যনৈমিত্তিক দেনা-পাওনার প্রশ্নে আটকে যায়, মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের প্রশ্নেও জর্জরিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিনো-আফ্রিকাবিষয়ক স্বপ্রণোদিত বিশেষজ্ঞ ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
ভাষান্তর: মিজানুর রহমান শেলী