ম. জাভেদ ইকবাল: সুুশান্ত মণ্ডলের আকস্মিক মৃত্যুতে তার স্ত্রী বাসন্তী মণ্ডল দিশেহারা হয়ে যান। সুশান্ত ছিলেন একজন কৃষক। নিজের দু’বিঘা জমি এবং অন্যের বর্গা নেওয়া চার বিঘা জমি নিয়ে মোট ছয় বিঘা জমিতে তিনি নিয়ম করে ১২ মাস সবজির চাষ করতেন। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা সবজি চাষের জন্য বিখ্যাত। এই উপজেলার সবজি এখন খুলনার সীমানা ছাড়িয়ে রাজধানী শহর এমনকি বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। সুশান্ত মণ্ডলের আকস্মিক মৃত্যুতে বাসন্তী মণ্ডল ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না কীভাবে স্কুলপড়–য়া দুই মেয়েকে নিয়ে জীবন কাটাবেন। স্বামীর কাজে নিয়মিত সাহায্য করতেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে তিনিও কৃষিকাজে নেমে পড়লেন। প্রথমে নিজের দুই বিঘা জমিতে সবজি চাষ করতে লাগলেন। উৎপাদিত সেই সবজির একটি অংশ পাইকারি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতিদিন সকালে খুলনার একটি বাজারে এসে তিনি সবজি বিক্রি করতে লাগলেন। দুই কন্যাকে নিয়মিত স্কুলেও পাঠাতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তার বিক্রি বাড়তে লাগল। তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। বাসন্তী জানান, মনের জোর আর ইচ্ছা থাকলে সবকিছুই করা সম্ভব। বাসন্তী মণ্ডলকে দেখে ডুমুরিয়ায় এখন অনেক নারী সবজি চাষ ও ব্যবসায় নেমেছেন।
দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন-সাপেক্ষে চার দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবদানের তুলনায় শিল্প ও সেবা খাতের অবদান বেড়ে চলেছে। ১৯১৭-১৮ অর্থবছরে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি’তে) কৃষির অবদান ১৬ শতাংশ। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষিতে এখনও মোট শ্রমশক্তির ৬২ শতাংশ নিয়োজিত আছে। বাংলাদেশের ৭২ শতাংশ মানুষ এখনও গ্রামে বাস করে। গবেষণায় দেখা গেছে, জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যহ্রাসের হারের ওপরে গ্রামীণ অর্থনীতির ব্যাপক অবদান রয়েছে।
শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, যদিও বর্তমানে তা ৩৬ দশমিক ছয় শতাংশ। শ্রমের সঙ্গে জড়িত আছে সাড়ে ছয় কোটি নারী। নারী শ্রমশক্তির ৬৬ শতাংশই কৃষিতে নিয়োজিত। গত দুই দশকে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১৩৪ শতাংশ, একই সময় কৃষিতে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে দুই শতাংশ। অর্থনীতিতে সরকারের নানামুখী প্রণোদনার কারণে কৃষি ও গ্রামভিত্তিক কাজ ছেড়ে পুরুষেরা শহরমুখী হচ্ছে। কৃষিতে নারীর এই ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রেখে চলেছে। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক নীতি গ্রহণ, কৌশলগত প্রণোদনা, বাজারের সঙ্গে সংযুক্তিতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন আর কোনো পরিবারই শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল নয়। গ্রামীণ নারীরাও কৃষি, কৃষিজ পণ্য, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পজাত বিভিন্নমুখী কাজে নিয়োজিত। পোলট্রি, গবাদিপশু, দুগ্ধশিল ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গ্রামীণ নারীদের বিভিন্নমুখী কাজে অংশগ্রহণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
গ্রামের মানুষের জন্য পেশা হিসেবে কাজের জায়গাগুলো যদি দেখার চেষ্টা করি, দেখা যাবে বিগত আশির দশকের প্রথম দিকে নারীদের পেশাগত কাজে খুব একটা দেখা যেত না, যা এখন প্রচুর চোখে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বগুড়ার ১০০ নারী এক মৌসুমে ২০ টন বীজ উৎপাদন করেছে। ফলে তাদের এই অবদানের কারণে অতিরিক্ত এক কোটি টাকার বেশি ফসল উৎপাদিত হয়েছে। এতেই বোঝা যায় জিডিপিতে নারীর অবদান কত। সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে বহু নারীর এমন অবদান রয়েছে। এ বিচ্ছিন্ন অবদানগুলোকে এক জায়গায় করতে পারলে দেশের পুরো চিত্রটি বোঝা যাবে। কোনো নারী একই সঙ্গে উদ্যোক্তা, শ্রমিক ও ম্যানেজারের ভূমিকায় কাজ করে। এগুলো হৃদয় দিয়ে আমাদের বুঝতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে কৃষিতে নারীর অবদান দিন দিন বাড়ছে। তাই সময় এসেছে কৃষিক্ষেত্রে নারীকে প্রকৃত মূল্যায়নের।
কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে। এতে করে নারীর মর্যাদাও বেড়েছে। তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। আর মর্যাদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীর প্রতি নির্যাতনও কমেছে। নারী শুধু মাঠে কাজ করছে না, নারীকে ঘরও সামলাতে হয়। নারীর ঘরের কাজের কোনো আর্থিক মূল্যায়ন হয় না। গবেষণায় জানা যায়, কোনো নারীর ঘরের সার্বিক শ্রমের আর্থিক মূল্যায়ন কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা। সুতরাং নারীর ঘরের কাজকে যদি মূল্যায়ন করা যেত, তাহলে সংসারে তার মর্যাদা আরও বাড়ত।
আবহমান বাংলাদেশে কৃষিকাজে বীজ সংগ্রহসহ অনেক কাজ করে নারী। দেশে গত দুই দশকে নারীর পেশাগত অংশগ্রহণ বেড়েছে। দেশে এখন নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন ঘটেছে। নারী উদ্যোক্তাকে সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করছে। কৃষি উন্নয়নে সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণও বেড়েছে। এখন সময় এসেছে কৃষিকাজে নারীর অবদানকে মূল্যায়ন করা। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। এ সবজি উৎপাদনের পেছনে নারীর বিশাল ভূমিকা রয়েছে।
নারীর অধিকার ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হলে নীতিমালা যেমন দরকার, তেমন নীতিমালা বাস্তবায়নও দরকার। সমাজে আজও নারীর সম্মানের জায়গাটা উপেক্ষিত রয়ে গেছে। আগের তুলনায় এখন কৃষিকাজে নারীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই তার পারিশ্রমিকও বেড়েছে। এখন প্রয়োজন নারীর এ পরিশ্রমের প্রতি সম্মান জানানো। নিজের জমিতে কাজ করতে কোনো নারী তার প্রাপ্য সম্মান বা স্বীকৃতি কোনোটাই পায় না, যেমন পেয়ে থাকে পুরুষ কৃষক। এজন্য নারীর কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে। মূল্যায়নের ফলেই নারীর প্রতি বৈষম্য কমবে। নারীর গৃহস্থালি ও সেবাকাজের স্বীকৃতি দুভাবে করা প্রয়োজন একটি সামাজিকভাবে, অন্যটি অর্থনৈতিকভাবে। তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে এবং সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে বিশ্বের বুকে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হব।
পিআইডি নিবন্ধ