কার্টুনই আমাকে রক্ষা করল

আলি দোরানি। একজন কার্টুনিস্ট। ২১ বছর বয়সে ইরান থেকে পালিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিতর্কিত মানুস দ্বীপে হন কারাবন্দি। সেখানকার কয়েদখানায় পরবর্তী চার বছর কাটে তার। কিন্তু তার কার্টুনগুলো যখন অনলাইনে প্রকাশ পেল, তখনই সবকিছু পাল্টে গেল। সেসব দিনের কাহিনি-চিত্র তার নিজের ভাষায় বিবিসিতে প্রকাশ পায়

গতকালের পর…………

মানুস দ্বীপে আমাকে আনা হলো; তখন আমার কাছে থাকল না কোনো কাগজ, না কোনো কলম। ক্রিসমাস দ্বীপ ছাড়ার সময়ই তারা আমার কাছ থেকে সব পেনসিল কেড়ে নিয়েছিল। তবুও আমি আঁকিবঁকি চালিয়ে গেলাম।
প্রথম দিকে অবশ্য আমার ছবি আঁকার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তারা কোনো নির্দিষ্ট একটি স্থানে তাদের ইচ্ছে মতো আমাকে থাকতে বাধ্য করল: সেখানে তারা কী করে তা আমার জানা ছিল না, কিংবা এসবের শেষ কোথায় তাও জানতাম না; তারা আমার আশা ভেঙে দিলে, তছনছ করে দিল আমার সব প্রেরণা; আর এই সবকিছু সেখানকার আবহাওয়া, রৌদ্রতাপ, মশা-মাছির উৎপাতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল আমার ভেতরটা ছিন্নভিন্ন করে দিল।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ। কিছু স্থানীয় লোক আশ্রয় শিবির আক্রমণ করল। গুঁড়িয়ে দিল সবকিছু। মানুষজনকে মারধর করল। এমনকি একজন আশ্রয়প্রার্থীকে তারা হত্যাও করল।
এক মাস পরের কথা। সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। যথাযথ খাদ্য আমরা পেলাম না, কোনো সেবাও
আমাদের ছিল না। এরপর অন্য একটি কোম্পানি এই শিবির চালানোর জন্য এলো। তারা খাওয়ার ঘরটার হাল-হকিকত ঝকঝকে-সুবিধাজনক করে দিল। শিবিরের মধ্যে বিভিন্ন কার্যাবলিতে পরিবর্তন আনল। এমনকি তারা এখানে ইংরেজি ক্লাস ও ড্রইং ক্লাস চালু করল।
আমিও আবার আঁকাআঁকি শুরু করলাম। আশ্রয় শিবিরের জীবন আমি আবারও ফুটিয়ে তুলতে লাগলাম আমার ছবির ক্যানভাসে। মশাদের আঁকলাম, আঁকলাম সূর্য, আরও বৃষ্টি।
এরপর আমার আঁকাআঁকির জন্য একটি পেননেইম (স্বাক্ষর নাম) বাছাই করলাম। ঠিক করলাম ‘ইটেনফিশ’ হবে আমার ছবির স্বাক্ষর নাম। কিন্তু কেন জানেন? কারণ আমাকে সাগর থেকে ধরে আনা হয়েছিল, যেভাবে সাগর থেকে মাছ ধরা হয়। তারপর মাছ খাওয়ার প্রক্রিয়া চলে, একইভাবে আমাকে অস্ট্রেলিয়ার কয়েদখানায় প্রক্রিয়াজাত করা হলো: এই প্রক্রিয়াকেই আমি ‘ইটেন’ [খাওয়া] বলেছি। তারপর আমাকে মানুস দ্বীপে ছুড়ে ফেলা হলো। একইভাবে আপনিও মাছ খেয়ে তারকাটা আবর্জনার পাত্রে ছুড়ে ফেলে দেন, তাই না! আমার কিছু ছবিতে আমি কবরের ছবি এঁকেছি। এই কবরগুলোতে মারা যাওয়া আশ্রয়প্রার্থীদের সমাহিত কার হতো।
যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতন ছিল মানুস দ্বীপের একটির ভয়ানক সংকটময় চিত্র। কেবল আমিই নয়, আমার মতো আরও বহু লোক সেখানে এই অত্যাচার ভোগ করেছে। আমি নিজেই তার সাক্ষী: একটি-দুটো ঘটনা নয় অহরহ। কিন্তু এ নিয়ে আমার কিছু করার ছিল না। কেননা আমি নিজেই সেখানে ইতোমধ্যে অনেক চাপের মুখে ছিলাম। আবার ওসিডি’র ভোগান্তি তো আমার ছিলই। আতঙ্ক আমার সব সময়ই তাড়া করে বেরাত, এর সঙ্গে ছিল গভীর উদ্বিগ্নতা।
এই দিনগুলোতে আমাদের ইন্টারনেটে প্রবেশের কোনো সুযোগ ছিল না। আর আমার ছবিগুলো বাইরের পুরো পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার কোনো সুযোগ ছিল না। এমনকি সে আশাও আমার ছিল না।
তবে ভাগ্য পাল্টে গেল। অস্ট্রেলিয়া সরকার শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল আমাদের মতো আশ্রয়প্রার্থীরাও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাবে সপ্তাহে ৪৫ মিনিট। পেলাম, কিন্তু ইন্টারনেটের গতি ছিল খুবই ধীর। এমনকি কেবল ফেসবুকে ঢুকতে পারলে বোঝা যেত আমাদের ইন্টারনেট কানেকশন খুবই শক্তিশালী পর্যায়ে রয়েছে। তবুও আমি ফেসবুকে প্রবেশ করতাম বহু চেষ্টার মধ্য দিয়ে। আর ফেসবুকে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন মানবাধিকার গ্রুপে যোগ দিলাম। ওইসব গ্রুপের প্রতিটি সদস্যের আমি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতে থাকলাম।
ফেসবুকে এই কাজটি আমি দেড় বছর ধরে চালিয়ে গেলাম। হাজার হাজার অচেনা লোককে আমি বার্তা পাঠাতাম। কেউই আমার ডাকে সাড়া দিত না।
যাহোক, এক সময় সবকিছু পাল্টে গেল; যখন অস্ট্রেলিয়ার বহু সংখ্যক কর্মী ও ইমিগ্রেশনে কাজ করা কর্মকর্তারা আশ্রয়কেন্দ্রে একসঙ্গে হতো তখনই তারা আমার আঁকিবুকি নিয়ে কথা বলত। এমনকি তারা বাড়ি গিয়েও আমার আঁকা ছবি নিয়ে গল্প বলত।
এই পর্যায়ে আমার এই জীবনের গল্পে যোগ হলো জ্যানেট গ্যালব্রেইথ। তিনি একজন সমাজকর্মী। আমার ছবি আকার কথা তিনি শুনেছিলেন। এরপর তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল ফেসবুকে। আমাকে বলল, সে মেলবোর্নের একটি গ্যালারিতে সে প্রদর্শনী করতে যাচ্ছে। প্রদর্শনীতে সে আমার একটি ছবি টানাতে চায়।
কিন্তু কাজটি আমার জন্য সহজ ছিল না। কেননা এখানে আমাদের জন্য কোনো স্ক্যানারের ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি কোনো ক্যামেরাও ছিল না। তবে কিছু লোক লুকিয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করত। সেসব মোবাইলের বেশিরভাগ ক্যামারাই ছিল খুব নি¤œ মানের।
অবশেষে এরকম এক নিচুমানের মোবাইল ফোন ক্যামেরা দিয়ে আমার একটি অঙ্কনের ছবি তুলতে সক্ষম হলাম খুবই গোপনে। তারপর তা তাকে পাঠিয়ে দিলাম।
জ্যানেট আমার ছবিটি গ্যালারিতে প্রদর্শন করল। পরে তা মানুস দ্বীপে কাজ করা একজনের দেখে। লোকটি আমার ছবি দেখেই জ্যানেটের সঙ্গে যোগাযোগ করে। জ্যানেটকে বলে আমি তাকে চিনি এবং তার কাছ থেকে তার ছবি এনে দেওয়ার কাজে তোমাকে সাহায্যও করতে পারি।
লোকটি যেহেতু সরকারি চাকরি করে, সেহেতু আমি তাকে ঠিকঠাক বিশ্বাস করতে পারলাম না। তবে একই সঙ্গে আমার হাতে আর কোনো বিকল্পও ছিল না। আমি তাকে আমার ছবিগুলো দিলাম।
সে আমার ছবিগুলো তারা আইপ্যাডে তুলে নিল এবং জ্যানেটকে পাঠিয়ে দিল। আর ধীরে ধীরে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে আমার ছবিগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করল।
২০১৫ সাল। অস্ট্রেলিয়ার নীতি ও আশ্রয় শিবিরের অবস্থার প্রতি আমাদের অনাস্থা ছিল। তাই অনেকেই এই অস্ট্রেলিয়ান নীতি ও আশ্রয় শিবিরের বিরুদ্ধে অনশন শুরু করল।
আমিও ছিলাম তাদের সঙ্গে। এক সময় খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। আতঙ্ক আমাকে আচ্ছন্ন করে নিল। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে আমার মাসল স্প্যাজম বা পেশির খিঁচুনি শুরু হলো। মাঝে মধ্যে এই ৪০ মিনিটের পেশি খিঁচুনি দিনে তিনবার আমার ওপর হামলে পড়েছে।
ডাক্তার তখন আমাকে ভিন্ন উপায়ে ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করল। কিন্তু এমন দিন এলো যখন আমি ঘুম থেকে জেগে উঠতাম আর সবকিছু ভুলে যেতাম। স্মরণ করতে পারতাম না কোথায় ছিল আমার স্থায়ী আবাস কিংবা আমি কে। প্রায় এক মাস ধরে আমি একঘোরে জীবন কাটাতে থাকি।
এক সময় আমি বুঝতে পারি আমি সবার থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছি। আমি আবারও জ্যানেটের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাকে আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলি। এ সময় আমি কার্টুনিস্ট রাইটস নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনালের (সিআরএনআই) সান্নিধ্য পেলাম। এই যোগাযোগটা সম্ভব হয়েছিল গার্ডিয়ানের কার্টুনিস্ট ফার্স্ট ডগ অন দ্য মুনের মাধ্যমে।
এরপর থেকে গার্ডিয়ান আমার কার্টুন ছাপাতে থাকে। এরপর এলো ২০১৬ সাল: সিআরএনআই আমাকে উৎসাহ দিতে তাদের এডিটোরিয়াল কার্টুনিং অ্যাওয়ার্ড দিল।
এই অ্যাওয়ার্ড আমার বিপুল পরিচিতি এনে দিল। কিন্তু তা আমি তখনই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি। কেননা, সে সময় আমার ইন্টারনেট যোগাযোগ ছিল খুবই সীমাবদ্ধ।
আমি কেবল আশপাশের মানুষের মুখে শুনতাম। তারা আমাকে যতটুকু বলত ততটুকুই বুঝতাম। তারা বলত আমার কাজ ও আমাকে বিভিন্ন মাধ্যমে পরিচয় করে দেওয়া হচ্ছে। আবার আমার বিভিন্ন কাজের লিঙ্ক বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আমাকে পাঠানো হতো। কিন্তু তার জন্য আমাকে সপ্তাহখানিক অপেক্ষায় থাকতে হতো। কেননা ইন্টারনেট রুমে আমি তো কেবল সপ্তাহে ৩০ মিনিটই সুযোগ পেতাম। এমনকি কখনও কখনও ইন্টারনেট কানেকশনও থাকত না।
তবে আমি কখনোই ভাবিনি যে, আমার এই পরিচিতি আমাকে সাহায্য করবে। অস্ট্রেলিয়ার মানুষকে আমার ড্রইং দেখানোর একটি সুযোগ বা প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই আমি এই পরিচিতিকে বিবেচনা করতাম। আমি কখনোই চিন্তু করিনি এই পরিচিতি আমাকে কোনো না কোনোভাবে কয়েদখানা থেকে মুক্তি দেবে।
কিন্তু ২০১৬ সালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীরা আমার প্রতি সমর্থন জানাতে কার্টুন আঁকা শুরু করল। আমার শিশু বেলায় স্বপ্ন ছিল, বড় হয়ে আমি কার্টুনিস্ট হবো। তখন আমি বিভিন্ন ম্যাগাজিন, পত্রপত্রিকায় কার্টুন দেখতাম। আমি মনে মনে এটাও ভাবতাম, একদিন আমার কার্টুনও এভাবেই প্রকাশ পাবে।
কিন্তু আমার জীবনের এই বাঁকে এসে দেখলাম, ছোটবেলা থেকে জগৎ খ্যাত যেসব কার্টুনিস্টদের ভক্তি করে এসেছে আমার মনের মণিকোঠায়, যাদের কার্টুন আমি ম্যাগাজিনে দেখেছি, সেই কার্টুনিস্টরাই আমাকে রক্ষার জন্য কার্টুন আঁকছে। এটা আমার জন্য এক বড় সম্মানের। আহা! এসব কার্টুনিস্ট ওয়াশিং পোস্ট, নিউ ইয়র্ক ও নিউ ইয়র্ক টাইমসে কার্টুন আঁকে আমাকে বা আমার ইটেনফিশ নিয়ে। কৃতজ্ঞতায় আমি নুয়ে পড়ি।
এরপর আসে ইন্টারন্যাশনাল সিটিস অব রিফিউজি নেটওয়ার্ক (আইকর্ন)। নরওয়েভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটির লেখক ও শিল্পীদের নিয়ে কাজ করে। তারা আমার এ মামলাটি নিয়ে কাজ শুরু করে দিল।
সে সময় আমি আইকর্ন সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। জ্যানেট শুধু আমাকে এটা বলেছিল যে, তারা আমার মামলাটি দেখছে। কিন্তু আমি কখনোই বিশ্বাস করিনি যে, তারা আমাকে সত্যিকার অর্থে সাহায্য করতে পারবে।
আমি ২০১৬ সালের শেষের দিকে অনশন ধর্মঘটে গিয়েছিলাম। কেননা, অন্যান্য কয়েদি এবং মানুস দ্বীপের বিভিন্ন কর্মী আমাকে তখন হেনস্তা করছিল।
এই ধর্মঘট ২২ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। আমি আগে থেকেই খুব অসুস্থ ছিলাম। কিন্তু আমি দেখলাম এই অনশনে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো বিকল্প নেই। অনশন শেষে আমার ওজন দাঁড়াল মাত্র ৪৩ কেজি।
অনশন শেষে আমাকে পাপুয়া নিউ গিনির একটি হাসপাতালে পাঠানো হলো। সেখানে আমি অন্তত তিন মাস থাকলাম। আমি হাসপাতালে থাকাকালেই নরওয়ের ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে একটি বার্তা পেলাম। তারা আমাকে স্বাগত জানাল। আমি সত্যিই তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
অবশেষে আমি নরওয়ের পথে বিমানে চড়লাম। জ্যানেট আমার সঙ্গী হলেন। কয়েক ঘণ্টা ধরে আমি শুধুই কেঁদেছি। আমার কান্না আমি কেবলই থামাতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। সাধারণত আমি কাঁদতে পারি না। কিন্তু এ সময় আমি আমার কান্নাই যেন থামাতে পারছিলাম না। আমার চোখের সামনে তখন কেবলই বছরের পর বছর ধরে কয়েদখানার সেসব চিত্র ফুটে উঠছিল। আর আমি ভাবতেই পারছিলাম না জীবনের এ গল্পখানি এভাবে শেষে হবে।
উত্তেজনা আমাকে পেয়ে বসেছিল। আর যখন আমি নরওয়ে পৌঁছালাম তখন আমি ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে পড়ি। কিছু লোক আমাকে নেওয়ার জন্য বিমানবন্দরে এলো। তারাই আমাকে আমার থাকার জায়গা দেখিয়ে দিল এবং আমি কী কী সুবিধা ও সেবা পাব তা জানিয়ে দিল।
তবে প্রথম প্রথম সেখানকার জীবন ততটা সহজ ছিল না। প্রথম ছয় থেকে আট মাস আমি খুব হতাশার মধ্যেই দিন পাড় করছিলাম। এমনকি মানুস দ্বীপে যতোটা হতাশা ছিল তার চেয়েও বেশি। এখনও তা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে।
কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে আমি খুব ভালো সহায়তা পেলাম। তাছাড়া বিভিন্ন উদ্বাস্তু সংগঠন থেকেও আমাকে সহায়তা দেওয়া হলো। বিশেষ করে আইকর্নের নাম উল্লেখ করতেই হয়। আমি বিশ্বাস করি, নরওয়েতে আমি যে সহায়তা পেয়েছি তার চেয়ে বেশি ভালো সহায়তা-সহযোগিতা অন্য কোথাও থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।
স্টাভেঞ্জারের একটি পাবলিক লাইব্রেরিতে আইকর্ন আমাকে একটি অফিস দিল। সেখানে আমি আমার প্রকল্প নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়ে গেলাম। লাইব্রেরিটিতে প্রচুর সংখ্যক শিশু ভ্রমণে আসে। কখনও কখনও আমি এখানে ড্রইং কোর্স চালায়।
আমি অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার উদ্বাস্তু নীতি নিয়ে কথা বলার জন্য বিভিন্ন স্কুলে যায়। আইকর্ন আমাকে এ কাজে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এমনকি আইকর্ন নরওয়ের বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক রাখার জন্য সাহায্যও করে থাকে।
অনেকেই জানতে চায় আমি সুখে আছি কি না আমার কেমন লাগছে। আসলে এটা খুব জটিল বিষয়।
আমি তো আসলে নিজে থেকে এখানে আসিনি। এখানে আসার প্রতি আমার নিজের কোনো আবেদন বা পছন্দ ছিল না। কিন্তু এই শহর আমি এখন ভালোবাসি। আমি
এখানেই বাস করি।
আমি মনে করি, উদ্বাস্তুদের জন্য নরওয়েতে রয়েছে খুব ভালো সহায়তা ও সেবা। এখানে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য কয়েদখানা আছে তবে তা তালাবদ্ধ খাঁচার মতো নয়। এখানকার কয়েদখানার শরণার্থীরা বাইরে যেতে পারে। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে। এমনকি পার্কে গিয়ে বাচ্চাদের খেলাধুলাও দেখতে পারে।
আমি সব সময়ই বলি শিল্পই আমাকে রক্ষা করে। দেখুন-না, আমাকে অবস্থান খুঁজে পেতে এই শিল্পই নরওয়ে সরকারকে সাহায্য করেছে।
ক্রিসমাস দ্বীপের কয়েদখানায় এবং মানুস দ্বীপে থাকাকালে বহু লোক আমার ড্রইংয়ের প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু আমাকে সেখান থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে সবাই তার অপারগতাই প্রকাশ করে চলত। কিছু কিছু হাজতি আমাকে জানতে চাইত, ‘এটা দিয়ে তুমি জীবনে কী অর্জন করতে চাও? তুমি তোমার এই ড্রইং দিয়ে কখনোই আমাদের এই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে পারেব না।’
কিন্তু এখন, এখন আমি খুব শক্ত করেই বলতে পারি নিতান্ত শিল্পই আমাকে রক্ষা করেছে। এটা বলার অধিকার এখন আমার রয়েছে। কয়েদখানায় আমি কার্টুন আঁকা শুরু করেছিলাম কেবল আমার অসুস্থতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। কিন্তু পরিশেষে কার্টুন আমার জীবন রক্ষা করল। আমি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করি শিল্পই পারে শান্তি বয়ে আনতে, আর তাই আমার শিল্পের যত্ন-আত্মি নিতেই হবে এর প্রতি আমার সম্মানও থাকবে নিরবধি। (শেষ)

বিবিসি নিউজ থেকে
ভাষান্তর: মিজানুর রহমান শেলী