এক বছরে ২৫৭ কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি উদ্ঘাটন

* ২৯ কর অঞ্চল, এলটিইউ ও জরিপে ২ হাজার ৮৮৬ আয়কর ফাঁকির মামলা

* নিষ্পত্তি করা ১ হাজার ৪৩৯ মামলা থেকে আদায় ২৭ কোটি টাকা

* ফাঁকি উদ্ঘাটন ও আদায়ে এগিয়ে কর অঞ্চল-১০

রহমত রহমান: দেশে প্রতি বছর কী পরিমাণ আয়কর ফাঁকি দেওয়া হয়, সেটির সঠিক তথ্য নেই। তবে বিশ্বের যে কয়টি দেশের জনগণ কর ফাঁকি দেয়, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, করদাতাদের প্রদর্শিত আয়ের ৭০ থেকে ৮০ ভাগই গোপন করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দেওয়া হয়।

গত অর্থবছর দেশের ২৯টি কর অঞ্চল, এলটিইউ ও জরিপ অঞ্চলে ২৫৭ কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়েছে। কর অঞ্চলের ‘গোয়েন্দা ও তদন্ত সেল’ এ ফাঁকির বিষয়টি উদ্ঘাটন করেছে। সম্প্রতি এনবিআরের অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন শাখা থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, আয়কর ফাঁকি উদ্ঘাটনে প্রতিটি কর অঞ্চলে ‘গোয়েন্দা ও তদন্ত সেল’ গঠনে ২০১৬ সালে এনবিআর একটি নির্দেশনা জারি করে। সে অনুযায়ী দেশের সব কর অঞ্চলে এ সেল গঠন করা হয়। এ সেল করফাঁকির অভিযোগ তদন্ত, রিটার্ন ও নথি যাচাই করে ফাঁকি উদ্ঘাটন ও কর আদায় করে আসছে। তবে জনবল ও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে সব কর অঞ্চল অনেক ফাঁকি উদ্ঘাটন করতে পারে না। ফাঁকি উদ্ঘাটন করে সম্প্রতি এনবিআরে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৯টি কর অঞ্চল, বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ-আয়কর) ও কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চলের গোয়েন্দা ও তদন্ত সেল ২০১৮ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১২ মাসে ২৫৬ কোটি ১০ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ টাকার আয়কর ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। এতে দুই হাজার ৮৮৬টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৪৩৯টি মামলা নিষ্পত্তি করে ২৭ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৫৬০ টাকা কর আদায় হয়েছে। বাকি এক হাজার ৪৪৭টি মামলায় বকেয়া রয়েছে ২২৯ কোটি ৯৫ লাখ ৮০ হাজার ৭২৬ টাকা। গোয়েন্দা ও তদন্ত সেলে মোট তিন হাজার ৬৫০টি অভিযোগ, নথি ও রিটার্ন যাচাই করা হয়। এর মধ্যে তিন হাজার ২৭০টি তথ্য ও অভিযোগ নির্বাচিত ও যাচাই করে দুই হাজার ৮৮৬টি মামলা করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অভিযোগ আর নথি যাচাইয়ের দিকে এগিয়ে রয়েছে ময়মনসিংহ কর অঞ্চল। দ্বিতীয় অবস্থানে কর অঞ্চল-১০। তবে মামলা করা ও মামলা নিষ্পত্তি এবং তা থেকে আয়কর আদায়ে শীর্ষে রয়েছে কর অঞ্চল-১০। এক বছরে ময়মনসিংহ কর অঞ্চল নথি যাচাই ও অভিযোগ পেয়েছে ৫৯২টি। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ২৮৮টি নির্বাচিত এবং ২৮৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটন (সৃষ্ট দাবি বা অতিরিক্ত দাবি) করা হয়। এ থেকে ৯৩টি মামলা নিষ্পত্তি করে প্রায় তিন কোটি টাকা আদায় করা হয়। আর কর অঞ্চল-১০ এক বছরে নথি ও অভিযোগ পেয়েছে ৫৮৪টি। এ থেকে প্রাথমিকভাবে ৪৩৪টি নির্বাচিত এবং ৩৬৫ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে ৪৪ কোটি টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। ৩১৪টি মামলা নিষ্পত্তি করে সাড়ে তিন কোটি টাকা আদায় করা হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর অঞ্চল-৩, ঢাকা ২৪৯টি নথি যাচাই ও অভিযোগের মধ্যে ১৭০টি প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত এবং যাচাই করে প্রায় ৫৭ লাখ টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। ৮৩টি মামলা নিষ্পত্তি করে দুই লাখ টাকা আদায় করা হয়। কুমিল্লা কর অঞ্চল ২১১টি নথি যাচাই ও অভিযোগের মধ্যে ২০৯টি প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত এবং যাচাই করে ১৬৭টি। এতে প্রায় ছয় কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। ১৪৩টি মামলা নিষ্পত্তি করে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়। এলটিইউ ১৬৮টি নথি যাচাই ও অভিযোগের মধ্যে ৮৩টি প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ও যাচাই করে। এর মধ্যে ৫৫টিতে প্রায় ১৩ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। ৩০টি মামলা নিষ্পত্তি করে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা আদায় করা হয়।

কর অঞ্চল-৪, ঢাকা ১৮৩টি নথি ও অভিযোগের মধ্যে ১৩৫টি নির্বাচিত ও যাচাই করে ১৩৫টিতে প্রায় ১০ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। ২৮টি মামলা নিষ্পত্তি করে প্রায় ১৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়। কর অঞ্চল-৮, ঢাকা ১৬০টি নথি ও অভিযোগের মধ্যে ১৬০টি নির্বাচিত এবং যাচাই করে ১৬০টিতে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। ৯৯টি মামলা নিষ্পত্তি করে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ টাকা আদায় করা হয়। কর অঞ্চল-১, ঢাকা ১৭৯টি নথি ও অভিযোগের মধ্যে ১৬৫টি নির্বাচিত ও যাচাই করে ১২৮টিতে প্রায় সাত কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। ২০টি মামলা নিষ্পত্তি করে প্রায় দেড় কোটি টাকা আদায় করা হয়। কর অঞ্চল রাজশাহী ১৫৯টি অভিযোগ যাচাই করে প্রায় আড়াই কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। ১০৪টি মামলা নিষ্পত্তি করে প্রায় দুই কোটি টাকা আদায় করা হয়।

আরও বলা হয়, কর অঞ্চল-২, ঢাকা ৭৩টি অভিযোগ যাচাই করে ৭৩টিতে প্রায় ১২ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। চারটি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। কর অঞ্চল-৫, ঢাকা ৭৭টি অভিযোগের মধ্যে যাচাই করে ৭১টিতে প্রায় ৮৫ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন এবং ৪৬টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। কর অঞ্চল-৬, ঢাকা ৬৮টি অভিযোগের মধ্যে যাচাই করে ৪০টিতে প্রায় আট কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন এবং ১৫টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। কর অঞ্চল-৭, ঢাকা ২১টি অভিযোগের মধ্যে যাচাই করে ছয়টিতে ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। কর অঞ্চল-৯, ঢাকা ৭৩টি অভিযোগের মধ্যে যাচাই করে প্রায় ১১ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন এবং ৫৮টি মামলা নিষ্পত্তি করে পৌনে তিন কোটি টাকা আদায় করা হয়।

কর অঞ্চল-১১, ঢাকা ১০৮টি অভিযোগের মধ্যে যাচাই করে ৩২টিতে প্রায় দেড় কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন এবং ২০টি মামলা নিষ্পত্তি করে। কর অঞ্চল-১২, ঢাকা ৬৯টি অভিযোগের মধ্যে যাচাই করে ৪৫টিতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন এবং ১৫টি মামলা নিষ্পত্তি করে। কর অঞ্চল-১৩, ঢাকা ৩৯টি অভিযোগের মধ্যে যাচাই করে একটিতে ফাঁকি উদ্ঘাটন এবং একটি নিষ্পত্তি করে। কর অঞ্চল-১৪, ঢাকা ৯১টি অভিযোগের মধ্যে যাচাই করে ৮২টিতে প্রায় ১০ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন এবং ৫৬টি মামলা নিষ্পত্তি করে। কর অঞ্চল-১৫, ঢাকা ৪৫টি অভিযোগ যাচাই করে। ১৬৬টিতে ৯ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন এবং ৬৯টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়।

কর অঞ্চল-১, চট্টগ্রাম ৯টি অভিযোগ যাচাই করে প্রায় তিন লাখ টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন, কর অঞ্চল-২, চট্টগ্রাম ৭টি অভিযোগ যাচাই করে ৭টি মামলা, কর অঞ্চল-৪ চট্টগ্রাম ৪২টি অভিযোগ যাচাই করে ৪৫টি মামলা, কর অঞ্চল বগুড়া ৩০টি অভিযোগ যাচাই করে ৪৬টি মামলা, কর অঞ্চল রংপুর চারটি, কর অঞ্চল বরিশাল ৬৩টি মামলা, কর অঞ্চল সিলেট ১৪৭টি মামলা, কর অঞ্চল খুলনা ২৯টি মামলা, কর অঞ্চল নারায়ণগঞ্জ ১১টি মামলা, কর অঞ্চল গাজীপুর ৯০টি মামলা এবং কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল পাঁচটি মামলা করে।