মুনাফা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে এবি ব্যাংক

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: দিন দিন জৌলুস হারাচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবি ব্যাংক। একসময় এই প্রতিষ্ঠান সন্তোষজনক মুনাফা করলেও খেলাপি ঋণ, প্রভিশনের চাপ ও তারল্য সংকটসহ বিভিন্ন কারণে বেসরকারি খাতে প্রথম প্রজন্মের এবি ব্যাংকের

চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) তালিকাভুক্ত এ ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি মুনাফা কমেছে ৫৪ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের ৯ মাসে এই মুনাফা কমেছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে শূন্য দশমিক ১৯ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল শূন্য ৪১ টাকা। এ হিসাবে ইপিএস কমেছে শূন্য দশমিক ২২ টাকা বা ৫৪ শতাংশ।

আর্থিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে হঠাৎ করেই মুনাফায় ধস নামে এই প্রতিষ্ঠানটির। এ বছর প্রতিষ্ঠানটি চার কোটি ছয় লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করে, যা এর আগের আর্থিক বছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ১৫১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। টাকার অঙ্কে মুনাফা কমে ১৪৭ কোটি টাকার বেশি। মুনাফায় বড় ধরনের ধসের কারণে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে যায় এবি ব্যাংক।

মূলত শ্রেণিকৃত ঋণ ও বাড়তি প্রভিশনের চাপে এ বছর ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমতে শুরু করে। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ঋণের সুদ ও বিনিয়োগ আয় কমার বিষয়টিও ব্যাংকটির পিছিয়ে পড়াকে ত্বরান্বিত করে।

২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত আর্থিক বছরে সুদ থেকে এবি ব্যাংকের আয় দাঁড়ায় এক হাজার ৮০৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, যা এর আগের আর্থিক বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরে সুদ আয় কমে ১৩৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ কারণে প্রকৃত সুদ আয়ও কমে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে বিরূপ বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশের হার কমায় ব্যাংকটির বিনিয়োগ আয়ও উল্লেখযোগ্য হারে কমে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ আয়ও আগের বছরের চেয়ে ৩৮ কোটি টাকা কমে যায়। এর পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির আর কাক্সিক্ষতভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। ২০১৮ সালে মুনাফা সামান্য বাড়লেও শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ওই বছর কোম্পানিটি চার কোটি ৩১ লাখ টাকা মুনাফা করে।

এদিকে তৃতীয় প্রান্তিকে কিছুটা বাড়তে দেখা গেছে এই প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা। তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে শূন্য দশমিক শূন্য চার টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা হয়েছিল শূন্য দশমিক শূন্য এক টাকা। তবে তৃতীয় প্রান্তিকে এই মুনাফা আমলে নিচ্ছেন না বাজারসংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিমত, সব নিয়মকানুন পালন করে বছর শেষে প্রতিষ্ঠানটি কেমন মুনাফা করে, সেটাই দেখার বিষয়।

এদিকে আয় মুনাফা কমে যাওয়ার জের ধরে তলানিতে নেমেছে এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের চাহিদা। বর্তমানে এ ব্যাংকের শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে অভিহিত দরের নিচে। গতকাল দিন শেষে এ শেয়ার লেনদেন হয় আট টাকায়।

জানতে চাইলে ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কয়েক বছরে শ্রেণিকৃত ঋণের কারণে ব্যাংকের বড় অঙ্কের অর্থ আটকে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশনের কারণে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। সবকিছু মিলে আমরা সমস্যার মধ্যে আছি, যে কারণে প্রতিষ্ঠানটির ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।’

একসময়কার আলোচিত এই ব্যাংকটি গত দুই বছর ধরে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ প্রদান করছে না, যে কারণে প্রতিষ্ঠানটি ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে অবস্থান করছে। এর মোট শেয়ারের মধ্যে ৩৪ দশমিক ১৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে। বাকি শেয়ারের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৩৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ, বিদেশিদের কাছে এক দশমিক শূন্য তিন শতাংশ এবং সরকারের কাছে রয়েছে শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ শেয়ার।

অন্যদিকে শেয়ারদর অস্বাভাবিকহারে কমে যাওয়ার কারণে এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ার নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বিপদে আছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও। কারণ দুই বছর আগে এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর ছিল ২৬ টাকা। ওই সময়ে যারা শেয়ার ক্রয় করেছিলেন, তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব বিনিয়োগকারীর পুঁজি কমে গেছে তিন ভাগের দুই ভাগ। 

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার নিয়ে দিন দিন তাদের দুশ্চিন্তা আরও ভারি হচ্ছে। কারণ শেয়ারদর এতটাই কমে গেছে যে, এখন তারা এই  কোম্পানি থেকে বের হতে পারছেন না।

এদিকে যারা সমন্বয় করে এই প্রতিষ্ঠান থেকে বের হতে চেয়েছিলেন, উল্টো তাদের লোকসান আরও বেড়েছে। সে কারণে এখন তারা সমন্বয় করতেও ভয় পাচ্ছেন।