ঋণে এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়নে প্রজ্ঞাপন আজ

শেখ আবু তালেব: ব্যাংকঋণে এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়নে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। উৎপাদনশীল খাতের নতুন ও পুরাতন সব ঋণেই এটি কার্যকর হচ্ছে। খেলাপি হওয়া ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনেও তা প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আজ এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন দিতে যাচ্ছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।

ব্যাংকঋণে উচ্চ সুদহার খেলাপি বৃদ্ধি হওয়ার অন্যতম কারণ বলে দাবি করে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এজন্য সুদহার কমিয়ে আনতে ব্যাংক উদ্যোক্তারা গত বছর পাঁচটি সুবিধা নেন। কিন্তু দেড় বছরেও তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেননি। বর্তমানে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু ঋণে ১০ শতাংশের নিচে সুদ নিচ্ছে।

জানা গেছে, শুধু নতুন ঋণে নয়, পুরোনো ঋণের বেলায়ও এটি প্রযোজ্য হবে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা এক অঙ্কের সুদহারের সুবিধাটি পাবেন না। বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে অর্থ আদায়ে ব্যাংক মামলা করেছে।

এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘উৎপাদনশীল খাতের সব ঋণেই এক অঙ্ক সুদহার হবে। পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের সময়ও ব্যবসায়ীরা এই সুদে ঋণ নিতে পারবেন। কিন্তু ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের এ সুবিধা দেওয়া হবে না।’ তিনি বলেন, এটি বাস্তবায়ন হলে সফলতা ভোগ করবে সব ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

তিনি আরও বলেন, ‘কারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি তা ব্যাংক নির্ধারণ করবে। যাদের নামে ব্যাংকের মামলা আছে, তারা এ সুবিধা পাবেন না। প্রজ্ঞাপনে তা স্পষ্ট করা হবে। প্রজ্ঞাপন হলে এটি নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যেও কোনো ধরনের সংশয় থাকবে না। কালই (আজ রোববার) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন দেবে।’

জানা গেছে, এখন পুনঃতফসিল ঋণেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ১০ শতাংশের নিচে সুদহার নির্ধারণ করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তারা এটি করছে। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপিরা ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন। কেউ চাইলে এককালীন পরিশোধ করে ঋণমুক্ত হতে পারবেন। সে ঘোষণায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বেশি আবেদন পড়েছে। কিন্তু কোনো ব্যাংকেই বড় খেলাপিরা সুবিধাটি নিতে আসেননি।

এতদিন সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় ব্যাংকগুলোকে মৌখিকভাবে বলা হয়েছিল সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য। কিন্তু এ বিষয়ে লিখিত কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি কোনো পক্ষ থেকে। এজন্য এটি বাস্তবায়ন করেনি বেসরকারি খাতের অধিকাংশ ব্যাংক। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসিল করেনি গণহারে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এই হারে সুবিধা দিয়েও কোনো ফল বয়ে আনবে না। এজন্য তারা মামলা দায়েরের মাধ্যমেই সমাধান করবে।

এসব সমস্যার মাঝেই নতুন সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে সব ঋণের সুদহার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এতে দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে। ব্যাংকের মুনাফা একটু কমলেও ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। পণ্যের উৎপাদন খরচ কমে যাবে, পরবর্তীকালে যার সুফল ব্যাংকও পাবে।

প্রসঙ্গত, কিন্তু সুদহার এক অঙ্কে অর্থাৎ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনেনি অধিকাংশ ব্যাংক। সর্বশেষ গত ১ ডিসেম্বর সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ওইদিন রাতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এতে সদস্য হিসেবে রাখা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকের চেয়ারম্যান-ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের।

কমিটি এ বিষয়ে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদন নিয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সভায় অনুমোদন হয়েছে। উৎপাদনশীল খাতে শুধু এই ঋণ বিতরণ করা যাবে। এই সুদহারে ঋণের সঙ্গে চলতি মূলধনও নিতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।’

পুরোনো ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এই সুদহার প্রযোজ্য হওয়ার বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু নতুন ঋণের ক্ষেত্রে এই সুদহার প্রযোজ্য হবে। আগামী বছরের (২০২০ সালের) ১ জানুয়ারি থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।’

এদিকে এক অঙ্কে সুদহার নামিয়ে আনতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অর্থ বিনা সুদে চেয়েছেন ব্যাংকাররা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত রয়েছে ১১ লাখ ছয় হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এ আমানতের প্রায় ২৪ শতাংশ হচ্ছে সরকারি।

উল্লেখ্য, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। এর বাইরে পুনঃতফসিল ও রাইট অফ মিলিয়ে ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।