শিশু ও মানব পাচার রোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা

কমল চৌধুরী: কবির ভাষায় ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। শিশুরাই হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ। আর এ কারণেই তাদের নির্যাতন, পাচার, শ্রম-শোষণ থেকে রক্ষা করে নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করা অত্যন্ত করুরি। এরই আওতায় আমাদের দেশেও শিশু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন আমাদের শিশুদের পুনঃসুরক্ষা দিতে পারছে না। যদিও শিশু নির্যাতন, যৌন হয়রানি, নারী নির্যাতন, শিশু ও মানব পাচার রোধে বাংলাদেশ সরকারের নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। দেশের প্রতিটি জেলায় নারী ও শিশুবিষয়ক বিশেষ আদালত রয়েছে। একজন জেলা জজ এ আদালতের বিচারকের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন।

শিশু ও মানব পাচার রোধে গণমাধ্যম তো বটেই, সংবাদমাধ্যমের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো (সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন সংবাদমাধ্যম) ও গণমাধ্যম কর্মী, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বর্তমান বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রেখে এসেছে এবং সমাজের বিকাশমান ইতিবাচক পরিবর্তনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তা আমাদের উন্নতি ও অগ্রগতিকে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোয়Ñসংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইনের মাধ্যমে শিশু ও নারীবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে, যা সচেতনতা সৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু অধিকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক শিশুদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের বিষয়টিও প্রাধান্য পায় প্রায় সব মাধ্যমেই এবং তারপরও নির্দ্বিধায় বলা যায়, অনেক সময় এই প্রধান দুটি বিষয়সহ শিশু অধিকারের অন্যান্য বিষয়ে মিডিয়ার তৎপরতা ইতিবাচক।

যদিও সম্প্রতি আমরা শিশুদের জন্য টিভি চ্যানেল দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু পত্রিকার পাতার কিংবা টিভি চ্যানেলগুলোতে এটা বলাই যায় যে, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত কোনো দিবসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় শিশুদের জন্য সংবাদ। সাধারণত দুর্ঘটনা, অপহরণ, খুন, ধর্ষণের মতো কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে নারী ও শিশু সংবাদ ছাড়া পত্রিকার পাতায় এবং অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমগুলোয় নারী ও শিশুদের অন্যান্য বিষয় তেমন স্থান পায় না।

ইউনিসেফের একটি গবেষণা প্রতিবেদনের অনুযায়ী, সব গণমাধ্যমে শিশুদের নিয়ে সংবাদ অনুষ্ঠান এবং তাদের অংশগ্রহণ মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। টেলিভিশনে বিনোদন এবং শিক্ষামূলক কিছু অনুষ্ঠানে শিশুদের অংশগ্রহণ থাকলেও সেসব অনুষ্ঠানে প্রকৃতপক্ষে শিশুরা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদের মতামত তুলে ধরার সুযোগ খুবই নগণ্য।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এবং টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদে শিশুদের উপস্থিতি শতকরা হার একেবারে নগণ্য। শিশুদের জন্য শিশুদের বিষয়-সংবলিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব খবর বা তথ্যগুলো প্রায়ই তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরিবেশিত। গবেষণা বা গভীর অনুসন্ধান ছাড়াই শিশুদের জন্য শিশুদের বিষয় সংবলিত সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত বা প্রচারিত হয়ে থাকে। শিশু ও নারীদের নিয়ে প্রতিবেদন বা পরিবেশিত সংবাদের ক্ষেত্রে একমুখী দৃষ্টিভঙ্গি ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের প্রভাব থাকে এবং বৈচিত্র্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে শিশু অধিকার লঙ্ঘন ও শিশু পাচারসহ শিশু নির্যাতনের যে চিত্র দেখা যায়, পত্রিকার পাঠক ও টেলিভিশন দর্শকের কাছে তার সামান্য অংশই তুলে ধরা হয়। গণমাধ্যমগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে কেবলই বড়দের ভাবনায় ছোটদের বিষয় প্রাধান্য পায়। পাচারের মতো ভয়াবহ ও সহিংস বিষয়গুলো সচেতনতা ও সুরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে খুব কম প্রাধান্য পায়।

অনলাইন মিডিয়াগুলোয় শিশুদের জন্য সংবাদ প্রচারের জন্য আলাদা কোনো ডেস্ক এখনও তেমন দেখা যায় না। শিশুদের বিকাশের জন্য বা শিশুদের পাচারসহ অন্যান্য সহিংস নির্যাতনের বিষয়ে সচেতনতার জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সর্বত্রই শিশুদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। শিশু ও নারীদের জন্য আদালতে বিশেষ কোনো পরিবেশ নেই এবং এ বিষয়ে আমাদের গণমাধ্যম এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রতিবেদন বা উচ্চারণ এখনও কম। শিশু আইনের বাস্তবায়নে আলাদা আদালত কক্ষ ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিশু আইনে ও মানব পাচার আইনের মামলাগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। সে বিষয়েও গণমাধ্যমগুলোর আরও বেশি সচেতন হতে হবে।

যেহেতু সংবাদমাধ্যম শিশুদের ভীষণভাবে প্রভাবিত করে, এক্ষেত্রে শিশুদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রয়োজন বড়দের চেয়েও বেশি। সুতরাং শিশু-সংক্রান্ত সব সংবাদে এ বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে সংবেদনশীলতা কাম্য। তাই শিশু ও নারীবান্ধব একটি সমাজ নির্মাণ খুবই প্রয়োজন। গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সংবাদকর্মীসহ এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের শিশু ও নারীবান্ধব মনোভাব-দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক প্রয়োগ এবং শিশুদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঘটনা বা পরিস্থিতিতে সংবাদ পরিবেশন ও উপস্থাপনায় শিশু ও নারীবান্ধব মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন প্রয়োজন।

নারী ও শিশুবিষয়ক সংবাদে অভিভাবক, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি এবং সরকার ও সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষের মতামত এবং প্রতিক্রিয়া পরিবেশনে সতর্ক ও যতœবান থাকা প্রয়োজন। শিশু সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করা এবং তার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করা প্রয়োজন।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে উল্লিখিত মূলনীতি অনুযায়ী, সব ক্ষেত্রে শিশুর অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিশুর বক্তব্য বা মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে তা সংবাদমাধ্যমে অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রচারসহ শিশু অধিকারের বিষয় নিয়ে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সাংবাদিকদের ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ এবং শিশু বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে শিশু সংবেদনশীল সংবাদ পরিবেশনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা খুবই প্রয়োজন।

পাচার এবং যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের উদ্ধার, তৎক্ষণাৎ জরুরি সেবা ও সহায়তা, নিরাপত্তা ও দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়, পর্যাপ্ত এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে মিডিয়াকে ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশনসহ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শিশু সুরক্ষা ও কল্যাণে যেসব আইন, বিধিমালা এবং কর্মপরিকল্পনা আছে তা কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে, তা গণমাধ্যমগুলোর নজর রাখা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশকে শিশুদের বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা এখন বিশ্বব্যাপী সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। এসব সহিংসতার ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি ছাড়াও সামাজিক এবং আর্থিক ক্ষতি হয়ে থাকে। বর্তমান সরকার নারী ও শিশুর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধকে দেশের টেকসই উন্নয়ন এবং শিশু অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করার ফলে বর্তমানে বাল্যবিবাহের হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সব ইউনিয়ন এবং পৌরসভায় চার হাজার ৮৮৩টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সবার পাশে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ঢাকায় ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার এবং ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার এবং ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেল স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সরকার পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০, এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০২, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ প্রণয়ন করেছে।

মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন এবং মানব পাচার অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও অধিকার বাস্তবায়ন এবং নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত এক আইন। কোনো ব্যক্তি মানব পাচারের অপরাধ সংঘটনের অভিপ্রায়ে বা যৌন শোষণ বা নিপীড়নসহ এই আইনের ধারা ২(১৫)-এ বর্ণিত ধারা অনুযায়ী, ‘অন্য কোনো শোষণের উদ্দেশ্যে অন্য কোনো ব্যক্তিকে অপহরণ, গোপন অথবা আটক করিয়া রাখিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং ধারা ১০(১)-এর অনুযায়ী উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ১০ (দশ) বৎসর এবং অন্যূন ৫ (পাঁচ) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ২০ (বিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

মানব পাচার রোধে সরকার যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নদী ও সাগর পথকেই সাধারণত শিশু ও নারী পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে পাচারকারীরা বেছে নিয়েছে। সরকারের নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও পুলিশবাহিনী নারী ও শিশু পাচার রোধে একযোগে কাজ করছে। সরকারের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ও বৃদ্ধিতে মিডিয়ার অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসা।

পিআইডি নিবন্ধ