স্বাভাবিকভাবে বাজেট করা যায়নি কিছু অসংগতি থাকতে পারে

নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনা মহামারির কারণে এবার স্বাভাবিক নিয়মে বাজেট প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি, কারণ বাজেটের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের স্বল্পতা ছিল। পাশাপাশি খুব সীমিত জনবল দিয়ে কার্য সম্পাদন করতে হয়েছে। কাজেই বাজেটে কিছু অসংগতি থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু এভাবে বাজেট প্রণয়নের বিকল্প আমাদের সামনে ছিল না। আর অন্য বছর আয়ের সংস্থানের ওপর ভর করে বাজেট প্রণয়ন করা হলেও এবার তা করা যায়নি। এবার দেশের মানুষকে বাঁচানোর তাগিদে আগে ব্যয়ের প্রাক্কলন করতে হয়েছে। অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে, সে বিষয়ে চিন্তার করার সুযোগ ছিল না।

বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে গতকাল এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় অনলাইনে। এতে সংযুক্ত হয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম,  অর্থবিভাগের সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম।

করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে এত বড় বাজেটের অর্থসংস্থান কীভাবে হবে, তা নিয়েই বেশিরভাগ সাংবাদিক প্রশ্ন করেন। এর জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাজেটের টাকা কোথা থেকে আসবে, তা ভাবিনি। আমাদের এবারের বাজেটের প্রধান লক্ষ্যই হলো মানুষকে রক্ষা করা। অন্যবার আয়ের সংস্থানের ওপর নির্ভর করে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়। কিন্তু এবার তা করা হয়নি। মানুষকে রক্ষা করার প্রয়োজনে আমরা প্রথমে টাকা খরচ করব, পরে আয় করব। আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে। তারপর টাকা জোগাড় করব।’

আগের দিন সংসদে দেওয়া বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, এবার দেশের অর্থনীতিতে ‘সেরা প্রবৃদ্ধিটি’ উপহার দেওয়ার প্রত্যয় তার ছিল। সরকারের ঈপ্সিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল আট দশমিক দুই থেকে আট দশমিক তিন শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাব সারা বিশ্বের অর্থনীতির হিসাব-নিকাশকে সম্পূর্ণভাবে ওলটপালট করে দিয়েছে।’

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে প্রবৃদ্ধি ও রাজস্ব প্রাক্কলন বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সবার আগে মনে রাখতে হবে, এই বাজেট ‘স্বাভাবিক বাজেট’ নয়। গতানুগতিক ধারার বাজেট এটা নয়। কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে ক্রান্তিকালের বাজেট। এ ক্রান্তিকালে আমরা পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পাইনি। বাজেট প্রণয়নের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ ছিল। ভিন্ন পন্থায় কাজ করতে হয়েছে আমাদের। এছাড়া আমাদের উপায় ছিল না।’ মুস্তফা কামাল বলেন, ‘সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে অতীতের অর্জনের ধারাবাহিকতায় আমরা বাজেটে আট দশমিক দুই শতাংশ জিডিপির লক্ষ্য ধরেছি।’ তিনি বলেন, ‘অতীতের অর্জনে আমরা দেখেছি, কয়েক বছর ধরে আমরা আট শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। আমরা, চীন ও ভারতই কেবল এমন প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।’ কভিড-১৯ সংকট ‘দ্রুত মোকাবিলা করতে পারলে’ ওই আট দশমিক দুই শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঠিকই পাওয়া সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে যে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হিসেবে পাওয়ার আশা করছেন, তার মধ্যে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা তিনি চান এনবিআরের কাছ থেকে। রাজস্বের এ লক্ষ্য অবাস্তব বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মুস্তফা কামাল বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত খুবই কম, ১০/১১ শতাংশ। এটাকে আমরা নতুন বাজেটের মাধ্যমে ১৫ শতাংশে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য এনবিআরকে পুরোপুরি অটোমেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

এই অটোমেশনের কাজটি মহামারির কারণে বিলম্বিত হলেও এখন যন্ত্রপাতি আনার ব্যবস্থা হয়েছে এবং অটোমেশন হলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যও পূরণ করা সম্ভব বলে অর্থমন্ত্রী মনে করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, কভিড-১৯ বেশিদিন প্রলম্বিত হবে না। আর সে বিবেচনা থেকেই ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট দিয়েছি। আমাদের অতীতের অর্জন অসাধারণ অর্জন। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে প্রতিবছরই আমরা জিডিপির যে লক্ষ্য ধরেছিলাম তার থেকে বেশি অর্জন করেছি। সর্বশেষ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমরা আট দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি।’

অর্থমন্ত্রী বলেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামো খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। নতুন বাজেটে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে ১৭টি এরই মধ্যে চালু হয়েছে। ১০০টি জোন চালু হলে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সবকিছু মিলিয়ে আমরা প্রত্যাশা করছি, কভিড-১৯ থেকে আমরা দ্রুত মুক্ত হব। আমাদের অর্থনীতি আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। আর সেটা যদি হয়, আমরা বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ধরেছি, সেটা অর্জিত হবে। আট দশমিক দুই শতাংশ যে প্রবৃদ্ধি ধরেছি, সেটাও অর্জন করতে সক্ষম হব। মোটকথা আমরা বাজেট বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব।’

করোনার কারণে ভারতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে পাঁচ লাখ রুপি করা হয়েছে। আর বাংলাদেশে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। এ সীমা আরও বাড়ানো উচিত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ভারতে কর জালের আওতা অনেক বড় এবং তাদের দেশে করদাতার আনুপাতিক হারও বেশি। বাংলাদেশে যদি করজালের আওতা বাড়িয়ে করযোগ্য সব মানুষকে এর আওতায় আনা যায়, তা হলে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো সম্ভব।

বাজেটে সরকার ব্যাংক থেকে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এত বেশি ঋণ নিলে তা অর্থনীতিতে কোনো সংকট সৃষ্টি করবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ব্যাংকগুলোয় পর্যাপ্ত উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। কাজেই সরকার যে পরিমাণ ঋণ নেওয়ার প্রাক্কলন করেছে, তা নিলেও ব্যাংক খাতে কোনো সমস্যা দেখা দেবে না।

প্রসঙ্গত, গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে আট দশমিক দুই শতাংশ ও মূল্যস্ফীতি পাঁচ দশমিক চার শতাংশ।