ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণে চুক্তি সই হয় ২০১৪ সালের জুনে। ওই বছর নভেম্বরে চুক্তিটি কার্যকর হয়। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি মূল সেতু নির্মাণে। একই অবস্থা নদীশাসন প্যাকেজেরও। ২০১৪ সালের নভেম্বরে চুক্তি সইয়ের পর ডিসেম্বরে তা কার্যকর হয়। এ প্যাকেজও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। এজন্য কাজের অগ্রগতির সঠিক তথ্য দিচ্ছে না চীনের দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে প্রকল্পটির তদারকি কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরামর্শকের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি এটি জমা দিয়েছে রেন্ডাল লিমিটেড অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস।
পদ্মা সেতু প্রকল্পটির প্রোগ্রাম ও অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করে এতে বলা হয়েছে, উদ্বেগের বিষয় হলো, মূল সেতু ও নদীশাসন উভয় অংশের ঠিকাদার অগ্রগতির তথ্য গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে উত্থাপন করছে না। তারা কাজের অগ্রগতি অর্থের ভিত্তিতে দেখাচ্ছে, যার ভিত্তিতে চুক্তি মূল্য পরিশোধ করা হয়। যদিও কাজের অগ্রগতি বাস্তবিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিমাপ করা হয়। এতে ঠিকাদারদের প্রতিবেদন কাজের অগ্রগতির সঠিক চিত্র প্রদর্শন করছে না। ফলে কাজের অগ্রগতির সঠিক অবস্থা জানা যাচ্ছে না।
অসন্তোষজনক পদ্ধতি হলেও তা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়, মূল সেতুর কাজ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই মাস পিছিয়ে আছে। তবে কাজের অগ্রগতিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সঠিক ট্রাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম। আর নদী শাসন কমপক্ষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক মাস পিছিয়ে আছে। তবে এটি বাস্তবিক নয়। দুই অংশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে নির্ধারিত সময়ে নির্মাণকাজ শেষ হবে না।
মূল সেতুর কাজের ধীর অগ্রগতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, পাইল ফাউন্ডেশনের কাজ একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এর মূল কারণ, ট্রায়াল পাইল সময়মতো শেষ হয়নি। নির্মাণ পরামর্শক ও ব্যবস্থাপনা পরামর্শক এজন্য সম্মিলিতভাবে পাইলিংয়ের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া গ্রহণে কাজ করছে। এদিকে মূল দুই প্যাকেজ ছাড়াও মাওয়া ও জাজিরা সংযোগ সড়কের অগ্রগতি যথাক্রমে তিন ও ছয় মাস পিছিয়ে আছে।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যবস্থাপনা পরামর্শকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে কাজের সঠিক অগ্রগতির চিত্র প্রদর্শনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগামীতে সঠিক প্রক্রিয়ায় প্রতিবেদন জমা না দিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সতর্কও করা হয়েছে। আশা করা যায়, এরপর থেকে নিয়মিত কাজের অগ্রগতির চিত্র পাওয়া যাবে।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামোর কাজ করছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। আর নদী শাসনের কাজ করছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। এ দুই অংশের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস।
বিস্তারিত অগ্রগতি বিশ্লেষণে বলা হয়, মূল অবকাঠামোর ঠিকাদার ২০১৫ সালে একটি প্রোগ্রাম গ্রহণ করে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ২০১৬ সালে আরেকটি প্রোগ্রাম চূড়ান্ত করে। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করবে আরও চারটি প্রোগ্রাম গ্রহণ করা হয়। এগুলোর বিপরীতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চুক্তির বিল অব কোয়ান্টিটিসের ভিত্তিতে অগ্রগতি দেখানোর কথা। পাশাপাশি পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি ‘এস’ রেখায় অগ্রগতি ও পাক্ষিক ভিত্তিতে অগ্রগতি প্রদর্শন করার কথা রয়েছে।
এক্ষেত্রে দুটি উদ্বেগের বিষয় রয়েছে। একটি হলো চায়না মেজর ব্রিজ কাজের কতটুকু সম্পন্ন হয়েছে তার সঠিক তথ্য প্রদান করছে না। এতে চীনে কতটুকু প্রি-ফেব্রিকেশন সম্পন্ন হয়েছে বা পাইলের কাজ কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তার সঠিক তথ্য জানা যাচ্ছে না। অপরটি হলো কাজের সঠিক অগ্রগতি না জানায় তা কতটুকু ধীরগতিতে চলছে, তা নিরূপণ করা যাচ্ছে না। তবে লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে এটি কমপক্ষে ১৭ শতাংশ পিছিয়ে আছে।
সূত্র জানায়, মূল অবকাঠামো নির্মাণে চুক্তির মেয়াদ আর মাত্র ২০ মাস অবশিষ্ট আছে। তবে এখনও পাইলের নকশা অনুমোদন হয়নি। ৪২টি পাইলের মধ্যে মাত্র ১০টি নকশা অনুমোদন করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। ফলে পাইল নির্মাণ সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। এছাড়া ৬ ও ৭নং পাইলের ৩৫০ ফুট গভীরে থাকা কাদার স্তরে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তা এক বছরেও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। বিষয়টি সমাধানে নকশা প্রণয়নকারী কোম্পানিকে উপ-ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে।
এদিকে পাইলিংয়ের কাজ শেষ না হওয়ায় পিলার নির্মাণ এখনও শুরু হয়নি। এতে নদী শাসনের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। মূল অবকাঠামোর চেয়ে নদী শাসন এগিয়ে থাকায় দুই প্যাকেজের কাজের মধ্যে সমন্বয় করা যাচ্ছে না।
নদী শাসন প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে নকশা প্রণয়নকালে নদীর গতিবিধি ছিল কিছুটা ভিন্ন ধরনের। সে সময় জাজিরা প্রান্তে বেশি ভাঙছিল নদী। তবে চুক্তির পর নদীর গতিবিধিতে পরিবর্তন এসেছে। এখন মাওয়া প্রান্তে ভাঙন বেশি হচ্ছে। এতে মূল সেতু ও সংযোগ সড়কের অবস্থা কিছুটা ঝুঁকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এজন্য দ্রুত নদী শাসন শেষ করা দরকার। এছাড়া নির্মাণ শেষে সেতু বিভাগের নিজ উদ্যোগে নদী শাসন পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এতে আরও বলা হয়, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে নদী শাসনের প্রোগ্রাম চূড়ান্ত করে সিনোহাইড্রো। অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে একটি ‘এস’ রেখাও চূড়ান্ত করা হয়। এছাড়া পাক্ষিক ভিত্তিতে অগ্রগতির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অগ্রগতির সঠিক চিত্র দেখাচ্ছে না। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য বোল্ডার ও জিও ব্যাগ কতটুকু স্টক রয়েছে ও কতগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, তার সঠিক অবস্থা জানা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাজের অগ্রগতি পিছিয়ে পড়লে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। এতে ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। যদিও দুই দফা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণে।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ২০১১ সালে প্রথম সংশোধনের সময় পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। তখন সড়কের পাশাপাশি রেলও যুক্ত করা হয় সেতুটিতে। আর ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।