এসএম নাজের হোসাইন: বৈশ্বিক মহামারি করোনাতে মানুষ চিকিৎসাসেবা নিয়ে যেভাবে মারাত্মক ভোগান্তিতে আছে, তেমনি ভাড়া বাড়িতে থাকা নিয়ে রয়েছে বিশাল অস্থিরতায়। ভাড়াটিয়াদের মাঝে কেউ করোনা-আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ হলেই অনেক ক্ষেত্রে শুরু হয় বাড়ি ছাড়তে বলা, বাসায় প্রবেশ করতে না দেওয়া এবং পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে বাসায় প্রবেশ। যথাসময়ে বাড়িভাড়া প্রদানে সক্ষম না হলে শুরু হয় ভাড়াটিয়ার আসবাবপত্র ও মালপত্র ফেলে দেওয়া বা আটকে রাখা, ভাড়া দিতে ব্যর্থ মেসের শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলা, মেসে বসবাসকারীদের আসবাবপত্র আটক, বিক্রি করাসহ নানা খবর প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। করোনায় দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ চাকরি ও আয়-রোজগার হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকার বড় বড় ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাসহ অনেকের জন্য অনেক ধরনের প্রণোদনা ও সুবিধা প্রদান করলেও মধ্যবিত্ত ভাড়টিয়াদের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো কিছুই ঘোষিত হয়নি। এর মধ্যে ঢাকা শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি বড় অংশ বাড়িভাড়া দিতে না পেরে পরিবার-পরিজনকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। অপর একটি অংশ কম ভাড়ায় আশ্রয় খোঁজার জন্য বাসা স্থানান্তর করেছেন। ক্যাবসহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকে করোনাকালে বাড়িভাড়া কমানো ও মওকুফের দাবি করা হলেও বাড়ির মালিকরা তাতে সাড়া দেয়নি। অনেকেই গৃহ নির্মাণ ঋণ, হোল্ডিং ট্যাক্স, আয়কর প্রভৃতির অজুহাত দেখাচ্ছে। আবার অনেকেই জীবনজীবিকা নির্বাহে বাড়িভাড়াই একমাত্র অবলম্বন বলে দাবি করছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্যের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়েই বেড়েছে পরিবহন ব্যয়, বাড়িভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের মূল্য এবং শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সেবা সার্ভিসের মূল্য, যা বদলে দিয়েছে জীবনের দৃশ্যপট। এর ফলে সাধারণ নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে গেছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া সমগ্র সমাজজীবনকে প্রভাবিত করছে। সরকার বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে ১৯৯১ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করলেও তা আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৯ সালে ক্যাব পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালে পাকা বাড়ি আট দশমিক ১৮ শতাংশ, মেসের বাসা সাত দশমিক ৯৯ শতাংশ ও বস্তি বাড়ির গড় ভাড়া বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কারণে মূল শহর থেকে অনেক পরিবার উপশহরে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এজন্য তাদের সন্তানদের পড়াশোনা ও যাতায়াতে ভোগান্তি বেড়েছে। অন্যদিকে ওয়াসার পানির দাম ও বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে। বলা বাহুল্য, করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের অঙ্গীকার করে সরকার বাসভাড়ার মূল্য দ্বিগুণ করলেও সেই অঙ্গীকারে বালাই নেই; বাসমালিক ও শ্রমিকরা নিজেদের ইচ্ছা ও খেয়াল-খুশিমতো বাসভাড়া আদায় করে চলেছে।
নগরজীবনে বাড়িভাড়া নিয়ে বহু মামলা ও বিরোধ প্রায়ই একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হিসেবে দেখা দিচ্ছেÑএকদিকে বাড়ির মালিক, অন্যদিকে থাকে ভাড়াটিয়া। বাড়ির মালিক চায় কিছুদিন পরপর বেশি ভাড়ায় নতুন ভাড়াটিয়াকে বাড়িভাড়া দিতে, অথবা পুরোনো ভাড়াটিয়া থাকলেও তার কাছে উচ্চ হারে ভাড়া দাবি করতে। পক্ষান্তরে ভাড়াটিয়া ভাড়ার মেয়াদ পর্যন্ত থাকতে চায়। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্তরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বাড়িভাড়াকে চিরস্থায়ী হিসেবে ধার্র্য করা যায় না। এর ফলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া বিরোধ একটি চিরচেনা দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। অথচ বাড়িভাড়া-সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনে রয়েছে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’। এ আইনে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে বাড়িভাড়া নিয়ে উদ্ভূত জটিলতা নিরসনে রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ আইন সম্পর্কে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া কেউই অবগত নয়, বা এ আইনের বিষয়ে কেউ আগ্রহী নয়। অন্যদিকে আইনটি বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায় আইনটি অভিভাবকহীনভাবে অকার্যকর থেকেই যাচ্ছে। জানা গেছে, আইনটি বাস্তবায়নে কোনো বিধিমালা আজ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। যদিও এ আইন কেন বাস্তবায়িত হচ্ছে না, সেজন্য রুলনিশি জারি করা হলেও অদৃশ্য কারণে তার কোনো জবাব আজ পর্যন্ত হাইকোর্টে দাখিল করা হয়নি। ফলে একদিকে যেমন এটি কাগুজে আইনে পরিণত হয়েছে, অন্যদিকে বাড়িভাড়া-সংক্রান্ত বিরোধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এই আইন সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের ধারণা দেওয়ার জন্য কোনো উদ্যোগও নিতে দেখা যায়নি।
অনেক বাড়িওয়ালা আছে, চুক্তিপত্রের মাধ্যমে কোনো কিছু সম্পন্ন করার প্রক্রিয়াকে অহেতুক ঝামেলাপূর্ণ মনে করে। ফলে তারা এই বিষয়টিকে এড়িয়ে চলে। ভাড়াটিয়াও একটি সুন্দর বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার লোভে চুক্তিপত্র সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহী হয় না। এর ফলে কোনো ঝুটঝামেলা দেখা দিলে তা নিয়ে অহেতুক হয়রানির শিকার হয়। অনেক সময় বাড়িওয়ালাও না জেনেশুনেই ভাড়াটিয়াকে বাড়িভাড়া দিয়ে ফেঁসে যায়, যখন দেখতে পায় ওই ভাড়াটিয়া তার বাড়িতে অবৈধ কিংবা বেআইনি কোনো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য যে কেউ ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’-এর আওতায় রেন্ট কন্ট্রোলারের কোর্টের আশ্রয় নিতে পারে। এ আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো বাড়িভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া কোনোভাবেই আদায়যোগ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়া বলতে এলাকাভিত্তিক উপযুক্ত ভাড়াকেই বোঝানো হয়েছে। এ ভাড়া বাড়ির মালিক ও ভাড়টিয়ার মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হতে পারে। আবার রেন্ট কন্ট্রোলারও এ ভাড়া নির্ধারণ করতে পারে। ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া পরিশোধ করা হলে বাড়ির মালিক তৎক্ষণাৎ ভাড়াপ্রাপ্তির একটি রশিদ বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর করিয়ে ভাড়াটিয়াকে প্রদান করবে। বাড়ির মালিক ভাড়ার রশিদের একটি চেক মুড়ি সংরক্ষণ করবে। বিনা রশিদে কোনো ভাড়া প্রদান করে থাকলে ভাড়াটিয়া কোনো সুবিধা পাবে না। অগ্রিম ভাড়া হিসাবে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা দাবি বা গ্রহণ করতে পারবে না। মানসম্মত ভাড়া অপেক্ষা অধিক হারে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করা হয়ে থাকলে এবং এই মর্মে কোনো চুক্তি থাকলেও তা কার্যকর হবে না। অর্থাৎ মানসম্মত ভাড়া অপেক্ষা অধিক হারে ভাড়া কোনো অবস্থাতেই আদায় করা যাবে না। তবে ভাড়া দেওয়ার পর বাড়ির মালিক নিজ খরচে বাড়িটির কিছু উন্নয়ন সাধন করলে কিংবা আসবাবপত্র সরবরাহ করলে, যা বাড়ি উন্নয়ন বলা যাবে, সেক্ষেত্রে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া যদি একমত হয়, তাহলে অতিরিক্ত ভাড়া ধার্য করতে পারবে। বাড়ির মালিক যদি কোনো কারণে কিংবা ভাড়াটিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কারণে ভাড়া টাকা নিতে অপারগতা প্রকাশ করে এবং ভাড়াটিয়া ডাকযোগে মানি অর্ডার করে ভাড়ার টাকা পাঠানোর পর বাড়ির মালিক যদি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, তখন ডাক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ফেরত পাওয়ার এক পক্ষকালের (১৫ দিন) মধ্যে ভাড়াটিয়া ওই টাকা ভাড়া নিয়ন্ত্রকের (আদালত) কাছে জমা দিতে পারবে। এই শর্ত পূরণ হলে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। শর্ত পূরণ না হলে ভাড়াটিয়া খেলাপকারী বলে গণ্য হবে এবং উচ্ছেদ থেকে রক্ষা পাবে না। ভাড়াটিয়াকে বাড়ির মালিক ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো অনুপযোগী বা বসবাসের অযোগ্য অবস্থায় রাখতে পারবে না। আশঙ্কামুক্ত অবস্থায় স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের জন্য বাড়িটি যে অবস্থায় প্রস্তুত রাখা উচিত, তা-ই বাড়ির মালিক করতে বাধ্য। নতুবা ভাড়াটিয়া বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে আবেদন করতে পারে। শুনানিক্রমে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক বাড়ির মালিককে নির্দেশ দিতে পারে। বাড়ির মালিক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে ব্যর্থ হলে ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রককে জ্ঞাত করিয়ে নিজে মেরামত করে নিতে পারবে। তবে খরচ এক বছরের মোট ভাড়ার ছয় ভাগের এক ভাগের বেশি হবে না। ভাড়ার মেয়াদ বৃদ্ধি করার কারণে কোনো ব্যক্তি ভাড়ার অতিরিক্ত প্রিমিয়াম, সালামি, জামানত বা অনুরূপ কোনো অর্থ দাবি বা গ্রহণ করার লক্ষ্যে ভাড়াটিয়াকে প্রদানের জন্য বলতে পারবে না (ধারা ১০)। ১২ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কোনো বাড়ির আসবাবপত্র ক্রয়ের জন্য শর্ত রাখতে পারবে না। ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে ভাড়া গ্রহণের লিখিত রসিদ প্রদানে বাধ্য থাকবে। এ রসিদ বিধি দ্বারা নির্বাচিত ফরমে স্বাক্ষর করে ভাড়াটিয়াকে প্রদান করতে হবে। বাড়ির মালিক ভাড়ার রসিদের একটি চেকমুড়ি সংরক্ষণ করবে। এ রসিদ সম্পন্ন করার দায়দায়িত্ব বাড়িওয়ালার। রশিদ প্রদানে ব্যর্থ হলে ২৭ ধারা অনুযায়ী ভাড়াটিয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ অর্থদণ্ড হবে। এ আইনে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার নির্দিষ্ট এলাকার জন্য কোনো ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। এ নিয়ন্ত্রক কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে দরখাস্তের শুনানি করতে পারবে। প্রয়োজনে বাড়ির মালিকও ভাড়াটিয়ার প্রতি নোটিস জারি করতে পারবে। প্রয়োজন হলে কোনো বাড়িতে প্রবেশ ও পরিদর্শনের ক্ষমতা থাকবে নিয়ন্ত্রকের। ১৫ ধারামতে, নিয়ন্ত্রক বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে বাড়িভাড়া এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, যেন এর বার্ষিক পরিমাণ বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত ওই বাড়ির বাজারমূল্যের ১৫ শতাংশের সমান হয়। বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার দরখাস্তের ভিত্তিতে দুই বছর পরপর নিয়ন্ত্রক মানসম্মত ভাড়া পুনর্নিধারণ করতে পারবে। চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া পরিশোধ করে থাকলে ভাড়াটিয়াকে হঠাৎ করেই কিংবা ইচ্ছা করেই উচ্ছেদ করা যায় না। চুক্তিপত্রের অবর্তমানে যদি কোনো ভাড়াটিয়া প্রতি মাসের ভাড়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করে, অথবা ঘরভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে জমা করতে থাকে, তাহলে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। ভাড়াটিয়া ভাড়া পরিাশোধে ব্যর্থ হলে আদালত তার বিরুদ্ধে উচ্ছেদের আদেশ দিতে পারেন। সাধারণত বাড়িভাড়া আইনের আওতায় যেসব কারণে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যায়, তা হলো: ভাড়াটিয়া সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের আওতায় ১০৮ ধারার পরিপন্থি কাজ করলে। এ ধারাতে উল্লেখ আছে, ভাড়াটিয়া সম্পত্তির দখল নেওয়ার সময় যে অবস্থায় ছিল, সেরূপ ভালো অবস্থায় রাখবে এবং মেয়াদ শেষে পূর্বাবস্থায় ফেরত দেবে। এ ধারামতে আরও উল্লেখ অছে, ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া ঘরের কোনো ক্ষতি হলে বাড়িওয়ালা তাকে সে সম্পর্কে নোটিস দেবে। ভাড়াটিয়া নিয়মিত ভাড়া প্রদান করলে যতদিন মেয়াদ আছে ততদিন পর্যন্ত নির্বিঘেœ দখল করতে পারবে। ভিন্নরূপ কোনো চুক্তির অবর্তমানে ভাড়াটিয়া বাড়িওয়ালার লিখিত সম্মতি ছাড়া বাড়ির কোনো অংশ উপ-ভাড়া দিলে কিংবা ভাড়াটিয়া যদি এমন আচরণ করে যার কারণে পার্শ্ববর্তী বাড়ির দখলকারীদের কাছে উৎপাত বা বিব্রতকর মনে হয় এবং ভাড়াটিয়া চুক্তিপত্রে উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও বাড়ির কোনো অংশ অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে বা করতে অনুমতি দেয়, তাহলে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে। বাসাবাড়ি, দোকানঘর, অফিস, গুদাম প্রভৃতি যদি মাসিক ভাড়ায় ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে ১৫ দিনের নোটিসে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যায়।
চুক্তি যদি বার্ষিক ইজারা হয় বা শিল্পকারখানা হয়, তবে ছয় মাসের নোটিসে উচ্ছেদ করা যায়। চুক্তিপত্রের মেয়াদ শেষ হলেও বাড়িওয়ালা যদি ভাড়া দিয়ে থাকে, তাহলে ধরে নেওয়া হবে যে, বাড়িওয়ালা চুক্তিপত্রটি নবায়ন করেছে। ভাড়াটিয়া নিয়মিত বাড়িভাড়া পরিশোধ করা অবস্থায় যদি বাড়িওয়ালা তাকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে, তাহলে আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার ভাড়াটিয়ার রয়েছে। সাধারণত বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার বিরুদ্ধে উচ্ছেদ ও ক্ষতিপূরণের মামলা করে থাকে। অপরদিকে ভাড়াটিয়া বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে ঘরভাড়া ফেরত, নিষেধাজ্ঞা, অগ্রিম টাকা ফেরত পাওয়া, নিষেধাজ্ঞাসহ ভাড়া ধার্যের মোকাদ্দমা করে থাকে।
বাংলাদেশে নগরায়ণ যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে, সেখানে ভাড়াটিয়ার সংখ্যা প্রতনিয়তই বাড়ছে। সরকারের মধ্যে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যারা আছে, তাদের মধ্যে একটি মহল ইচ্ছাকৃতভাবে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত জনগণের এ বিশাল সমস্যাকে অবজ্ঞা করায় এবং নিজেরা বাড়ির মালিক হওয়ায় আইনটি কার্যকর হচ্ছে না। অন্যদিকে বাড়ির মালিকরা সংগঠিত এবং ভাড়াটিয়ারা সংগঠিত নয়। আর কেউ আইনের আওতায় আসতে চায় না। এ কারণে বাড়িভাড়া নিয়ে ভাড়টিয়া হিসাবে ভাড়াটিয়ারা ঠকছে। তবে এই ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী কিন্তু অবহেলা করার মতো নয়। অনেকের মতো ঢাকা শহরের ৯৫ লাখ এবং চট্টগ্রামের ৪০ লাখের অধিক ভাড়াটিয়া আছে, যারা রাজনীতির একটি বড় নিয়ামক। তবে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের আইনটি কার্যকর না থাকায় ভাড়াটিয়াদের ভোগান্তি দিন দিন বাড়ছে। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া কেউই আইনের তোয়াক্কা করছে না। আর আইনটি কার্যকর করার জন্য বিধিমালাও চূড়ান্ত হয়নি। ফলে এ আইন জনগণের কোনো কাজেই আসছে না। শুধু বসতবাড়ি নয়, অফিস-দোকানপাটসহ নানা ক্ষেত্রেই এ আইনটি প্রযোজ্য। তাই বাড়িভাড়া নিয়ে বিরোধ নিরসনের ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ জরুরি এবং এই আইনের সংশোধন ও পরিবর্তন যেমন জরুরি, তেমনি স্থানীয়ভাবে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠা করা দরকার। না হলে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়ে এক দিন বিস্ফোরণ ঘটাবে, যা ২০১২ সালে চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় এবং পরে ঢাকার আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে। আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার না চাইলে চুক্তি কার্যকরসহ বিভিন্ন বিষয়ে সালিশ-মীমাংসা কিংবা আপসের মাধ্যমেও এ ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তির দিকে সচেষ্ট থাকতে হবে। যদি কেউ বিরোধ নিষ্পত্তি করতে চায়, তবে মামলা চলা অবস্থাতেও এ ধরনের বিরোধ প্রত্যাহার করা সম্ভব। বাড়িভাড়া, সেবা সার্ভিস ও পণ্যমূল্য যা-ই থাকুক না কেন, তা যদি ক্রেতা-ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তাহলে কোনো কথা থাকে না; কিন্তু করোনা মহামারি চলাকালে দেশে চাকরিহীন, আয়-রোজগারহারা মানুষের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। একটি বিশাল জনগোষ্ঠী সঞ্চয় ভেঙে ধারদেনায় জীবন-জীবিকা ঠিক রাখতে কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত। নতুন কর্মসংস্থানের পথ একদিকে খুবই সংকুচিত হচ্ছে, অন্যদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক শিল্প কলকারখানায় ঝুলছে তালা। এ অবস্থায় যদি আবাসনের জন্য বাড়িভাড়া, পণ্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য জনগণের নাগালের মধ্যে না থাকে, তাহলে সরকারের হাজারো প্রচেষ্টা ও ইতিবাচক দিকগুলোও ম্লান হয়ে যেতে পারে। তাই অবিলম্বে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’ সংশোধন, আইনটির বাস্তবায়ন ও বিধিমালা দরকার। একই সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তিতে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন, পৌরসভা) প্রতিষ্ঠানগুলোকে সালিস-মীমাংসার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া বিপুলসংখ্যক ভাড়াটিয়ার ভোগান্তি ও জীবন-জীবিকা নির্বাহে সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। তাহলেই ভাড়াটিয়াদের প্রতি সুবিচার করা হবে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
cabbd.nazer@gmail.com