নবজাতক ও শিশু মৃত্যুরোধে সরকারের পদক্ষেপ

ডা. সুমাইয়া ইয়াসমিন রিতু: আজকের শিশু আগামীর কর্ণধার। তবে অসুস্থ শিশু সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করতে পারে না, কারণ অসুস্থ শিশুর পক্ষে ভালো কিছু করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে শিশুর অসুস্থতার প্রধান কারণ অপরিণত সময়ে ও কম ওজনে জন্ম গ্রহণ করা। এ জন্য সরকার সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে প্রান্তিক মানুষের হাতের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।

২০৩০ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে অধিকতর টেকসই ও সুন্দর বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সর্বজনীনভাবে একগুচ্ছ সমন্বিত কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এতে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ও ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

টেকসই অভীষ্টের তিন দশমিক দুই হলো ২০৩০ সালের মধ্যে নবজাতক ও পাঁচ বছর বয়সের নিচে শিশুদের প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু নাশ করা। এটি বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। সহযোগী মন্ত্রণালয় হিসেবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়ও দায়িত্ব পালন করছে। এক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করছে ও করবে, তা জনগণকে অবহিত করার মাধ্যমে সচেতন করা। এর মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ ও অংশিদারিত্ব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সৃষ্টি হয়।

সুস্থ শিশুর জš§ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গর্ভবতী নারীর প্রসবপূর্ব (গর্ভকালীন), প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি গর্ভবতী মহিলাদের অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদান এবং কোনো জটিলতা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব প্রসূতিকে জরুরি প্রসূতিসেবা কেন্দ্রে পাঠানো নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে এ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পরিচালনা করা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের আওতাভুক্ত গ্রামগুলোর মধ্যে থেকে মনোনীত প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিউনিটি গ্রুপ তৈরি করা হয়। এই কমিউনিটি  গ্রুপ কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়ে থাকে এবং ৩০ ধরনের ওষুধ বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হয়।

সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর হার সন্তোষজনকভাবে কমেছে। কিন্তু শূন্য থেকে ২৮ দিন বয়সের শিশুদের মৃত্যুর হার আশানুরূপভাবে কমেনি।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী দুই হাজার ৫০০ গ্রামের কম ওজন নিয়ে কোনো শিশু জন্ম গ্রহণ করলে একে প্রিম্যাচিউরড বেবি বলা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত যেসব নবজাতকের জন্ম হয়, তাদের কেএমসির প্রয়োজন পড়ে না। কেএমসি হলো মায়ের ত্বকের সঙ্গে নবজাতকের ত্বকের স্পর্শ। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ সময়ের আগে শিশুর জন্ম । প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে এক শিশুর জন্ম হয় অপরিণত নবজাতক হিসেবে। সারা বিশ্বে বছরে এক কোটি ৫০ লাখ নবজাতকের জন্ম হয় সময়ের আগে। এর মধ্যে এক কোটি নবজাতক মারা যায় কম ওজনে জন্ম জটিলতায়। কোনো নারী ৩৭ সপ্তাহের আগে নবজাতকের জন্ম দিলে তার অপরিণত সন্তান হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও কম ওজনের সন্তান হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আমাদের দেশে ৬০ শতাংশ নবজাতকের জন্ম হয় বাড়িতে। ফলে ওজন মাপা সম্ভব হয় না। তাই শিশু কম ওজনে জন্ম নিলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুযোগ হয় না। পরবর্তীকালে শিশু বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। ৪০ সপ্তাহ ধরে মায়ের পেটে সন্তান আদর, অক্সিজেন, উদ্দীপনা ও পুষ্টি গ্রহণ করে। কিন্তু সময়ের আগে সন্তান প্রসব হলে বাইরের পরিবেশে বিপরীত উদ্দীপনা পায়। অপরিণত নবজাতকের চোখ ও কানের সমস্যাসহ অনেক রোগ দেখা দেয়। এজন্য সচেতনতার মাধ্যমে জনগণকে হাসপাতালমুখী করতে হবে। হাসপাতালের নিউট্রিশন কর্নার ও স্ক্যান কর্নারের সেবা এবং ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারের বিদ্যমান সেবার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার মাধ্যমে এ সেবা গ্রহণে উৎসাহিত করা দরকার। এর মাধ্যমে নবজাতকের মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব।

২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাসহ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ২০১৭-২২ মেয়াদে এক লাখ ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি (চতুর্থ এইচপিএএসপি) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যার ৮৪ শতাংশ অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার। শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং মেটারনাল, নিওনেটাল ও চাইল্ডহুড অ্যাডোলেসেন্ট হেল্থ প্রকল্প দুটি সরকার বাস্তবায়ন করছে। এরই মধ্যে মোট দুই হাজার ৮৫৪টি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে সার্বক্ষণিকভাবে নিরাপদ প্রসবসেবা এবং ৭২টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র (২৫টি), তিনটি ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং কুমিল্লায় একটি ১০০ শয্যাবিশিষ্ট শিশু হাসপাতাল নির্মাণের সরকারি সিদ্ধান্ত রয়েছে। বর্তমান সরকার এরই মধ্যে ১৪৫টি উপজেলায় পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় নির্মাণ করেছে। দেশে মোট ১৩ হাজার ৮৬১টি কমিউনিটি ক্লিনিক বর্তমানে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে। ৬৫টি উপজেলা হাসপাতাল ও ২৭টি জেলা হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে নতুন ১০ শয্যাবিশিষ্ট ৭০টি এমসিডব্লিউসি নির্মাণ ও আরও ২৫০টি কমিউনিটি ক্লিনিক পুনর্নির্মাণসহ পুরোনো দুই হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আধুনিকায়ন এবং নতুন এক হাজার ২৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

১৯৯৮ সালে চালু হওয়া প্রথম সেক্টর কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কার্যক্রম অব্যাহত আছে। ইপিআই কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীকে ২০১৯ সালে গ্যাভি সচিবালয় কর্তৃক ভ্যাকসিন হিরো সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে পলিওমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ-সংক্রান্ত কার্যক্রম ১৩টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। বর্তমান অর্থবছরে এ খাতে মোট বরাদ্দ ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির এক দশমিক তিন শতাংশ। শিশুর জীবন রক্ষা নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে অঙ্গীকার করে ২০৩৫ সাল নাগাদ প্রতিরোধযোগ্য শিশুমৃত্যু বন্ধ করার। জাতীয় নবজাতক স্বাস্থ্য কর্মসূচি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এভরি নিউবর্ন অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সরকারের ওই অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত হয়েছে।

সরকারের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ। এর আওতায় সেবার মানোন্নয়নে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের কাছে সেবা পৌঁছানো, জরুরি ধাত্রী সেবা এবং স্পেশাল নিউবর্ন কেয়ার ইউনিটের (এসসিএএইউ) সংখ্যা ও সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

গর্ভকালে, সন্তান প্রসবের সময় এবং সন্তান জন্মের প্রথম সপ্তাহে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হলে তা প্রতিরোধযোগ্য নবজাতকের মৃত্যু ও গর্ভে শিশুমৃত্যু রোধে বড় ভূমিকা রাখে। কম ওজনের ও আকারে ছোটো এবং অসুস্থ নবজাতকের জন্য বিশেষ সেবার ব্যবস্থা জীবনরক্ষার জন্য খুবই প্রয়োজন। সুষ্ঠু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চললে নবজাতকের মৃত্যু ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত এবং শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। সে কারণে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে মা, চিকিৎসক ও অন্যদের সাবান দিয়ে হাত ধোয়া নিশ্চিত করতে কাজ করে যেতে হবে পরিবার থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে। তাহলেই আমরা দেশকে উপহার দিতে পারব সুস্থ মা ও শিশু।

পিআইডি নিবন্ধ