নিজস্ব প্রতিবেদক: কভিড-১৯-এর সঙ্গে বন্যা আর অতিবৃষ্টির কারণে এ বছর কাঁচা বাজারে চলছে দাম বাড়ার হিড়িক। উচ্চ দামে কিনতে হচ্ছে প্রায় প্রতিটি পণ্য। নিত্যপণ্যের কাঁচা বাজার, সবজি, মাছ-মাংস, ফলমূলের দাম গেল বছরের এই সময়ের তুলনায় বেশি। বন্যায় কাঁচা মরিচের গাছ পচে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই মরিচের বাজারে আগুন। এরই মধ্যে সপ্তাহের ব্যবধানে ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। আর বাজারে ৫০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না কোনো ধরনের শাকসবজি। নিত্যপণ্যের এমন উচ্চ দাম নিয়ে শঙ্কিত সাধারণ মানুষ।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচা বাজার ও আড়ত ঘুরে দেখা যায় এই অবস্থা। মিরপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, আগারগাঁও ও কাওরান বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
পেঁয়াজের বাজারে অস্থিতিশীলতা গত বছরের মতো না হলেও বিগত বেশ কয়েক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে দাম বেড়ে প্রতি কেজি কিং (দেশি) পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এ পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি। দেশি পেঁয়াজ (ছোট সাইজ) বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি। এটি এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা করে। আর আমদানি করা পেঁয়াজ (ভারত) বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা করে; যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা।
অন্যদিকে বেশ কয়েক মাস ধরে নাগালের বাইরে থাকা কাঁচা মরিচের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে কিছুটা কমেছে। এক সপ্তাহ আগে ২০০ থেকে ২২০ টাকা কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হলেও এখন তা কমে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে শীতের সবজির মধ্যে অন্যতম বাঁধাকপি, ফুলকপি ও শিম। পুরো শীত মৌসুমে দেশের সর্বত্র এসব সবজি পাওয়া যায়। তবে সময়ের বিবর্তনে বদলেছে অনেক কিছু। ভ্যাপসা গরমের মধ্যেই এখন রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে মিলছে এসব সবজি। তবে দাম বেশ চড়া। শীতের কোনো সবজিই ৫০ টাকার নিচে মিলছে না।
শীতের মৌসুমে যে শিমের কেজি ২০ টাকায় বিক্রি হয়, তা এখন ২০০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। ছোট আকারের ফুলকপি, বাঁধাকপির পিস বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা। এমন আকাশচুম্বী দামের পরও একশ্রেণির ক্রেতা নতুন এই সবজি কিনতে বাজারে ছুটছেন। এসব ক্রেতা বলছেন, এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে বাজারে সব ধরনের সবজির দাম চড়া, এর মধ্যে নতুন আসা সবজির দাম চড়া হবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া নতুন সবজির প্রতি সবারই বাড়তি এক ধরনের আকর্ষণ থাকে।
বাজারে নতুন সবজির ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান বাজার চিত্রে নতুন সবজি হিসেবে ফুলকপি, বাঁধাকপির দাম তুলনামূলক কম। কারণ গত বছর সবজির দাম বর্তমানের তুলনায় কম ছিল। কিন্তু গত বছর ফুলকপি, বাঁধাকপি বাজারে যখন নতুন আসে তখন দাম এর চেয়ে বেশি ছিল।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, চারজনের পরিবারের এক বেলার জন্য দুটি লাগবেÑএমন ছোট আকারের ফুলকপির পিস বিক্রি হচ্ছে ৩০-৫০ টাকায়। একই দামে বিক্রি হচ্ছে বাঁধাকপি। শিমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২০০ টাকায়।
শীতের এসব আগাম সবজির এমন দামের বিষয়ে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের হিসেবে এবার শীতের আগাম সবজি শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপির দাম তুলনামূলক কম। কারণ গত বছর নতুন অবস্থায় শিমের কেজি ২৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে, অথচ এখন ১৮০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আর গত বছর নতুন অবস্থায় বাঁধাকপি, ফুলকপির পিস বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকার ওপরে, এখন ৩০ টাকা বিক্রি করছি।
তিনি আরও বলেন, বাজারের অন্য সবজির দামের সঙ্গে তুলনা করলে দেখবেন, এখন সব ধরনের সবজির দাম বেশি। এখন তো বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজির কেজি বিক্রি হচ্ছে না। সেখানে ৩০ টাকা দিয়ে এক পিস ফুলকপি, বাঁধাকপি পাওয়া ক্রেতাদের জন্য সুখবরই।
রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাজারে শিমের কেজি ২০০ টাকা এবং বাঁধাকপি ও ফুলকপি ৫০ টাকা পিস বিক্রি করছেন ব্যবসায়ী মো. রাজীব। তিনি বলেন, শীতের আগাম সবজি শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি কয়েকদিন ধরেই বাজারে আসছে। নতুন আসায় এখন এগুলোর দাম একটু বেশি। আর কিছুদিন গেলে এবং সরবরাহ বাড়লে এসব সবজির দাম আরও কমে যাবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য সবজির দামও কমবে।
এদিকে বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শুধু কাঁচা পেঁপে ছাড়া প্রায় সব সবজির কেজি ৫০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে। কাঁচা পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি। ঝিঙা, ধুন্দল, চিচিঙা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি।
টমেটোর কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। গাজর আমদানি করাটা ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। লাউ প্রতি পিস ৬০ থেকে ৭০ টাকা। গোল বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। আর লম্বা বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি। করলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০-১০০ টাকায়। বরবটি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা কেজি। এছাড়া পটোল, কাঁকরোল বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা কেজি।
শেওড়াপাড়া থেকে বাজার করা হারুন-উর-রশিদ বলেন, সবজির এখন যে দাম তাতে মাছ-মাংসের চেয়ে সবজির পেছনেই বেশি টাকা খরচ হচ্ছে। দুই মাসের বেশি হয়ে গেছে, ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে এখন নতুন সবজি হিসেবে ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম পাওয়া যাচ্ছে। ৮০ টাকা দিয়ে দুটি ফুলকপি কিনেছি, এতে আমাদের চরজনের পরিবারে বড়জোর দুই বেলা খাওয়া হবে।
শরিফুল ইসলাম নামের এক ক্রেতা বলেন, দামের কারণে সবজি খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছি অনেকদিন হয়ে গেছে। কিন্তু একেবারেই সবজি না খেলে হয় না। তাই মাঝেমধ্যে অল্প পরিমাণ সবজি কিনি। এরপরও ১০০ টাকার সবজি দিয়ে একদিন চলে না।
এছাড়া আদা, রসুন ও আলুর দামও গত সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে। আলু গত সপ্তাহে খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা কেজি, শুক্রবার তা বিক্রি হয় ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়।
দেশি রসুন গত সপ্তাহে ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি। তা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা কেজি। আর আমদানি করা রসুন বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি।
আমদানি করা আদার কেজি বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৪০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। তবে দেশি আদার দাম কিছুটা কমে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হচ্ছে।
দাম বৃদ্ধির ধারায় রয়েছে ব্রয়লার মুরগিও। গত সপ্তাহে ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও শুক্রবার তার দাম উঠেছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। পাকিস্তানি কক ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা এবং লেয়ার মুরগি ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি বিক্রি হতে দেখা যায়।
তবে এদিন গরুর মাংসের কেজি ৫২০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়, যা ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা ছিল। খাসির মাংসের কেজি ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়, যা আগে ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।
মাছের দাম রয়েছে আগের মতোই। ইলিশের প্রচুর জোগান থাকায় দাম রয়েছে একদম নাগালের মধ্যেই। এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭৫০ টাকা কেজিদরে। এক কেজির কম ইলিশের দাম ৫০০-৬০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া রুই ২৫০-৩০০, শোল মাছ ৫৫০-৬০০, বড় বোয়াল ৭০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। অন্যান্য সব মাছ প্রায় আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে।