নিজস্ব প্রতিবেদক: অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালির যে দীর্ঘ ত্যাগ আর সংগ্রামের ইতিহাস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনকে তারই প্রতিচিত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
গতকাল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে জাতির পিতার সমাধিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর মোদি দর্শনার্থী বইয়ে এভাবে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘অধিকার, নিজস্ব সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের জন্য বাংলাদেশের মানুষের যে সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুর জীবন তারই প্রতিচিত্র। তার অবিনাশী চেতনা আর অদম্য সাহস কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তারা পরিণত হয়েছে বিজয়ী জাতিতে।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জš§শতবার্ষিকী উপলক্ষে দুদিনের সফরে গত শুক্রবার ঢাকায় আসেন নরেন্দ্র মোদি।
সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল তিনি টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সে পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুল দিয়ে মোদিকে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার উপস্থিতিতে দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করে মোদি সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন। তিনি একটি গাছের চারা রোপণ করেন।
দর্শনার্থী বইয়ে তিনি লেখেন, ‘ভারতবাসী বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে একজন বীর হিসেবে, সেই ভারতবাসীর পক্ষে আমি ২০ শতকের এই মহান রাষ্ট্রনেতার প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।’
গতকাল বেলা ১১টা ২০ মিনিটে তিনি হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছান। পরে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনিই প্রথম বিদেশি সরকারপ্রধান, যিনি টুঙ্গিপাড়া সফর করেছেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর নরেন্দ্র মোদি বঙ্গবন্ধুর সমাধির সামনে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। উপস্থিত সবাই তারপর দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন।
গতকাল সফরের দ্বিতীয় দিন সকালে তিনি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের যশোরেশ্বরী কালীমন্দির পরিদর্শন করেন ও পূজা দেন। পরে হেলিকপ্টারে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে রওনা হন। যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ ও খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান ওড়াকান্দি মন্দির পরিদর্শন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। বাংলাদেশকে বিশ্বে বিকাশ ও পরিবর্তনের শক্তিশালী উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত এই প্রচেষ্টায় সহযাত্রী।
তিনি বলেন, ‘ভারত আজ সকলের সঙ্গে, সকলের বিকাশ এবং সকলের বিশ্বাস এই মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ এতে সহযাত্রী।’
মোদি বলেন, ‘এই দিনের এই পবিত্র মুহূর্তের প্রতীক্ষা আমার বহু বছর ধরে ছিল। ২০১৫ সালে যখন আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার বাংলাদেশে আসি, তখনই আমি এখানে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলাম। আমার সেই প্রত্যাশা ও কামনা আজ পূর্ণ হলো।’
মোদি আরও বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ নিজেদের বিকাশ ও প্রগতির চেয়ে সমগ্র বিশ্বের উন্নতি দেখতে চায়। আজ সমগ্র বিশ্ব যে মূল্যবোধের কথা বলে, মানবতার যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, সেই মূল্যবোধের জন্য হরিচাঁদজী নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।’
বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়ে মোদি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের জাতীয় অনুষ্ঠানে ভারতের ১৩০ কোটি ভাইবোনের পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য শুভেচ্ছা নিয়ে এসেছি। আপনাদের সবাইকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ায় অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। গতকাল ঢাকায় জাতীয় দিবস পালনের সময় আমি বাংলাদেশের শৌর্য ও ক্ষমতার এবং সংস্কৃতির অপূর্ব প্রদর্শন দেখেছি, যা এই অপূর্ব দেশ দেখিয়েছে, তার অংশীদার আপনারাও।’
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর কথা তুলে ধরে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, তাঁর দূরদর্শী দৃষ্টি আর বাংলাদেশের মানুষের ওপর তাঁর বিশ্বাস এক উদাহরণ।’
ওড়াকান্দিতে মোদি আরও বলেন, ‘আজ ভারত ও বাংলাদেশের সামনে যে ধরনের একই রকম চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা সমাধানের জন্য শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুপ্রেরণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের একজোট হয়ে প্রত্যেকটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা উচিত। এটি আমাদের কর্তব্য, দুই দেশের কোটি কোটি জনগণের কল্যাণের পথ।’
কভিড-১৯ মহামারি প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা মহামারির সময়ে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই নিজেদের সামর্থ্যরে পরিচয় দিয়েছে। আজ উভয় দেশ মহামারির জোরদার মোকাবিলা করছে, একসঙ্গে মিলে মোকাবিলা করছে। ভ্যাকসিন বাংলাদেশের নাগরিকের কাছে যাতে পৌঁছায় ভারত এটিকে নিজেদের কর্তব্য মনে করে কাজ করছে।’
বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির একান্ত ও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। এ সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে নানা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পাশাপাশি ভার্চুয়ালি নানা প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। পরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সন্ধ্যায় নয়াদিল্লির উদ্দেশে রওনা হন নরেন্দ্র মোদি।