আদরিয়া ইসলাম: সভ্যতার শুরু থেকেই মানবসমাজে কোনো-না-কোনোভাবে অসমতা বিরাজ করছে। এই অসমতা সমাজেরই সৃষ্টি। বর্তমান বিশ্বের সব পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন অসমতার অবসান করে সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(১)-এ আছেÑ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।’ এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য হ্রাসে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করছে। দলিত, হরিজন ও বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এখনও মূল স্রোতের সঙ্গে মিশতে পারেনি। ফলে তারা কলোনিভিত্তিক, গোষ্ঠী বা গোত্রভিত্তিক জীবনযাপন করে যাচ্ছে অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। বড় বড় শহরের একটু বাইরে গেলেই দেখা যাবে বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীরা যেন অস্পৃশ্য। তারা পানি খেতে দোকানে গেলেও গ্লাস নিয়ে যেতে হয়। এরা শিক্ষিত হলেও এদের অচ্ছুত মনে করা হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় অবদানকে অস্বীকার করা হবে। এসব জনগোষ্ঠীকে দূরে রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী নিগৃহীত, অবহেলিত, বিচ্ছিন্ন ও উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। জেলে, সন্ন্যাসী, ঋষি, বেহার, নাপিত, ধোপা, হাজাম, নিকারী, পাটনি, কাওড়া, তেলী, পাটিকার প্রভৃতি তথাকথিত নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠী এ সম্প্রদায়ভুক্ত। সমাজের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্নভাবে তাদের সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে, বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ ২৯ হাজার ১৩৫ জন অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং ৭৫ হাজার ৭০২ জন বেদে জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাঁশফোর, ডোমার, রাউত, তেলেগু, হেলা, হাঁড়ি, লালবেগী, বাল্মিগী, ডোম প্রভৃতি হরিজন সম্প্রদায়। যাযাবর জনগোষ্ঠী বেদে সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। এ জনগোষ্ঠীর ৯৯ শতাংশ মুসলিম এবং ৯০ শতাংশ নিরক্ষর। আটটি গোত্রে বিভক্ত বেদে জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মালবেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারি, বরিয়াল সান্দা ও গাইন বেদে প্রভৃতি। তাদের প্রধান পেশা হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসা, তাবিজ-কবজ বিক্রি, সর্পদংশনের চিকিৎসা, সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো, সাপ বিক্রি, আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যসেবা, শিংগা লাগানো, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, কবিরাজি, বানর খেলা, জাদু দেখানো প্রভৃতি।
কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে সমাজের দরিদ্র ও বৈষম্যের শিকার মানুষের দরিদ্রতা ও বৈষম্য হ্রাস করার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সরকার বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভিজিএফ, ভিজিডি, হিজড়া জনগোষ্ঠী, চা-শ্রমিক, দলিত, হরিজন ও বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। উপজেলা ও শহর সমাজসেবা অফিস, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তরসহ সরকারি অন্যান্য দপ্তরের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেবাভোগী বাছাইকরণের প্রধান ভূমিকা পালন করছে ইউনিয়ন পরিষদ। বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর লোকরা সামাজিক বৈষম্য, বঞ্চনা, অস্পৃশ্যতা, ঘৃণা, সমাজবিচ্ছিন্নতা, মর্যাদাহীনতা, পেশাচ্যুতি, ভূমি দখল, অবহেলা, নিরাপত্তাহীনতা, রাষ্ট্রীয় পরিষেবাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় এই জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার এই জনগোষ্ঠীকে একটি মর্যাদাপূর্ণ ও বৈষম্যহীন জীবনদানে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় আনতে সবসময় সচেষ্ট আছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তর ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাইলট কর্মসূচির মাধ্যমে সাতটি জেলায় বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি কার্যক্রম গ্রহণ করে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৪ জেলায় বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখে। এ বরাদ্দ থেকে স্কুলগামী দলিত, হরিজন ও বেদে শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে চার স্তরে (জনপ্রতি মাসিক প্রাথমিক ৭০০, মাধ্যমিক ৮০০, উচ্চ মাধ্যমিক এক হাজার এবং উচ্চতর এক হাজার ২০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি প্রদান; ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের জন্য এ বিশেষ ভাতা জনপ্রতি মাসিক ৫০০; বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধকমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে তাদের সমাজের মূলস্রোতধারায় আনয়ন এবং প্রশিক্ষণোত্তর পুনর্বাসন সহায়তা প্রদান করা হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুই হাজার ৮৭৭ জনকে শিক্ষা উপবৃত্তি, ৪৫ হাজার জনকে অক্ষম ও অসচ্ছল ভাতা, ২৪২০ জনকে প্রশিক্ষণ এবং দুই হাজার জনকে প্রশিক্ষণোত্তর পুনর্বাসন সহায়তা দেয়া হয়।
বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সমস্যার অন্ত নেই। আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদনসহ বিভিন্ন সমস্যায় তারা জর্জরিত। দরিদ্র ও বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ব্যতীত উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সম্ভব নয়। সরকার দেশের সব দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে বরাদ্দ ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, যা যথাক্রমে বাজেট ও জিডিপির ১৬ দশমিক ৮৩ ও তিন দশমিক শূন্য এক শতাংশ।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষাকে আইনি বলয়ের আওতায় আনার জন্য বর্তমান সরকারের আমলে প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন ২০১১, শিশু আইন ২০১৩, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩, নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩ এবং বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ আইন ২০১৯।
বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলস্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে হলে আইন বা সরকারি স্বীকৃতির পাশাপাশি সামাজিকভাবে তাদের গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে ওঠাতে হবে; প্রাচীনকালের সেই বৈষম্য, নিপীড়ন আর বিদ্রুপ থেকে এই জনগোষ্ঠীকে রেহাই দিতে হবে। এ সম্প্রদায়কে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, জাতীয় উৎসব ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং সর্বোপরি তাদের বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তা, বিনোদন ও কর্মসংস্থানের যথাযথ ব্যবস্থা করে নিতে হবে।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও এনজিওগুলোর উন্নয়নমূলক কর্মসূচি, গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদক্ষেপ বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনের ধারাকে অব্যাহত রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করতে এবং টেকসই ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি তৈরি করতে সমাজ থেকে দারিদ্র্য ও বৈষম্যকে চিরতরে বিদায় জানাতে হবে। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব বলে আশা করা যায়।
পিআইডি নিবন্ধ