পটুয়াখালী ও উল্লাপাড়া গণহত্যা

কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে গোটা দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠিত করে। পরবর্তী ৯ মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি নিধন অব্যাহত থাকে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। ১৯৭১-এর এপ্রিল মাসেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশে প্রায় ২০টি গণহত্যা সংগঠিত করে। তার মধ্যে ২৫ এপ্রিল ভোররাতে ও ২৬ এপ্রিল  সংগঠিত হয় পটুয়াখালী গণহত্যা ও সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া (সলঙ্গা) গণহত্যা।

পটুয়াখালী গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক এক মাস পর এদিনে পটুয়াখালী শহরে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা চালায়। সেদিন সকাল সাড়ে ৯টা। হঠাৎ শহরের দুই প্রান্তে দুটি জঙ্গি বিমান নেমে আসে। ক্রমাগত শেলিং করে গুঁড়িয়ে দেয় টিঅ্যান্ডটি টাওয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা বন্দুক নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। অতর্কিত হামলায় দিশাহারা হয়ে পড়ে শহরবাসী। কিছুক্ষণ পর পশু হাসপাতাল সংলগ্ন মাঠে আরও দুটি হেলিকপ্টারে নামে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের প্রথম আক্রমণের শিকার হয় মাদবরবাড়ির নিরীহ মানুষ। সেখানে ক্রমাগত গুলি চালিয়ে হত্যা করে নারী ও শিশুসহ ১৯ জনকে। এরপর বিটাইপ এলাকায় ছয়জন আনসার ও একজন তথ্য কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করে পাকসেনারা। পাকবাহিনীরা সহস্রাধিক নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে শহরের পুরানবাজার এলাকায় লুটপাট করে অগ্নিসংযোগ করা হলে আতঙ্কিতরা লোহালিয়া নদী সাঁতরে প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু শহর পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। টানা তিন দিন তিন রাত সেখানে ধরে জ্বলে আগুন। সেই দিন থেকেই শুরু হয় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ।

উল্লাপাড়া গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল ভোর রাতে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার (বর্তমান সলঙ্গা থানা) হাটিকুমরুল ইউনিয়নের সাতটি গ্রামে বর্বরোচিত গণহত্যা চালায় পাক-হানাদার বাহিনী। পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্রাশফায়ারে সেদিন প্রায় দুই শতাধিক মুক্তিকামী বাঙালির মৃত্যু হয়। ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল পাবনা জেলার কাশিনাথপুর ডাববাগান নামক স্থানে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধে অর্ধশতাধিক পাকহানাদারের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে তারা ২৫ এপ্রিল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে কাশিনাথপুরের উদ্দেশে যাত্রা করে। পথে বগুড়া-নগরবাড়ী সড়কের সলঙ্গা থানার চড়িয়া শিকার নামক এলাকায় ব্যারিকেডের মুখে তারা যাত্রাবিরতি দেয়। চড়িয়া শিকারের পূর্ব দক্ষিণ পাশে কাশিনাথপুর নামে অন্য একটি গ্রামের সন্ধান পায় তারা। এ গ্রামকেই পাবনা জেলার কাশিনাথপুর মনে করে পাকবাহিনী খুঁজতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। সেখানে তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায় সন্ধান পান চড়িয়া মধ্যপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ঘাঁটির। পাকবাহিনী সেখানে সূর্যোদয়ের পূর্ব হতে সকাল ৯টা পর্যন্ত গুলি করতে থাকে। তারা এলাকার ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দেয়। সেদিন বিকালে তারা চড়িয়াশিকারসহ আশপাশের ৭টি গ্রামের মুক্তিকামী মানুষকে আটকের পর দুই লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে সবাইকে গুলি করে হত্যা করেন। এ হত্যাযজ্ঞে চড়িয়া মধ্যপাড়া, পাটধারী, কালিবাড়ী, শিকার মগড়াপাড়া, চড়িয়া শিকার দক্ষিণপাড়া, গোলকপুরকাচিয়া গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক নিরীহ মানুষ শহীদ হন। এদের মধ্যে ৩৫ জনকে চড়িয়া মধ্যপাড়া পুকুরপাড় ও পাটধারী অন্ধ পুকুরপাড়ে গণকবর দেয়া হয়।

১৯৭১ সালে এদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা ইতিহাসের নির্মম ঘটনা। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেও হার মানায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তারাই অনুপ্রেরণা হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজš§কে পথ দেখাবে।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর