জলবায়ু পরিবর্তনে নতুন আতঙ্ক তীব্র দাবদাহ

অতিমারি কভিডের ছোবলে গোটা পৃথিবী যখন বিপর্যস্ত তখন উত্তর আমেরিকায় এক নতুন সংকটের উত্থান ঘটেছে। অগ্নিঝরা তাপমাত্রায় কানাডাসহ যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঞ্চলে জনজীবন ঝুঁকিতে পড়েছে। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া অঙ্গরাজ্যের লায়টন শহরে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। পূর্বে ১৯৩৭ সালে ওই অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্তমানে কানাডার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টল্যান্ড, অরিগন, ওয়াশিংটন, নেভাদা অঙ্গরাজ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পৌঁছে দাঁড়িয়েছে ৪৬.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তীব্র তাপদাহে জনজীবন হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। হিটস্ট্রোক ও শ্বাসকষ্টে এ পর্যন্ত মারা গিয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ। মেরু অঞ্চলে এমন তাপমাত্রা নতুন তাই শিগগির খাপ খাওয়াতে পারছে না এ অঞ্চলের অধিবাসীরা। শীতপ্রধান দেশ হওয়ার দরুন পর্যাপ্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার ও নেই অঞ্চলগুলোতে। ফলে ভিড় জমছে সুইমিংপুলগুলোতে, ইনডোর স্টেডিয়ামে, পার্ক ও সমুদ্র সৈকতে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও করোনার টিকা কেন্দ্রগুলো, জারি হয়েছে জরুরি অবস্থা।

সাধারণত এমন অস্বাভাবিক গরম আগে কখনও অনুভব করেনি তারা। জুন মাসে সাধারণত একটু গরম অনুভূত হয় কিন্তু রেকর্ড ছাপানো তাপমাত্রায় জনজীবন তীব্রভাবে অতিষ্ঠ ও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এদিকে তীব্র গরমে ছড়িয়ে পড়েছে দাবানল। সহগ্রাধিক মানুষ হয়েছে বাস্তুহারা। এতে করে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ও  আলবার্টা অঙ্গরাজ্যজুড়ে তাপবিষয়ক জরুরি সতর্কতা জারি করেছে দেশটি। আবহাওয়াবিদদের মতে, পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সম্ভাবনা হয়েছে। কিন্তু শীতপ্রধান দেশে হঠাৎ মরু অঞ্চলীয় উত্তাপ কেন প্রবাহিত হবে এ নিয়ে সবাই সন্দিহান। যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক এটাকে প্রাথমিকভাবে একটা জলবায়ু ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যা হিট ডোম নামে পরিচিত। এই হিট ডোম-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য বাতাস বায়ুমণ্ডলের একটি নির্দিষ্ট স্থানে আটকা পড়ে এবং আশপাশের বাতাস প্রবাহিত হতে বাধা দেয়। ওপরের শীতল বায়ু নিচের উষ্ণ বায়ুর ওপরে চাপ প্রয়োগ করে, ফলে বাতাস সংকোচিত হয়ে আরও বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। হিট ডোম বায়ুমণ্ডলের অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও অতি সম্প্রতি হিট ডোমের ফলে উষ্ণতা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে; যার মূল কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। বিশ্বকে এক গভীর সংকটের মুখে পতিত করেছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। আবহাওয়াবিদরা অগ্রিম সতর্কবার্তাতে বলেছেন, অদূর ভবিষ্যতে এমন উত্তাপ হানা দেবে বারবার। খরাপ্রবণ হয়ে উঠবে শীতপ্রধান অঞ্চলগুলো। উত্তর আমেরিকা ছাড়াও ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশে তীব্র দাবদাহ আঘাত হানবে। ফলে মহাসাগরীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রাসহ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়বে।

গ্রীষ্মকালে মেরু অঞ্চলীয় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অত্যধিক বেড়েছে। বিপন্ন হয়ে পড়ছে মেরু অঞ্চলের প্রাণীদের জীবন। পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে হাজার হাজার বন্য ও সামুদ্রিক প্রাণী। আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে রাজধানী ঢাকাসহ পাঁচটি বড় শহর আগামী বছরগুলোতে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। বর্তমান প্রবণতা চলমান থাকলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহ Ñএই চারটি জেলা শহরে রাত ও দিনের তাপমাত্রার তারতম্য কমে আসবে, সবসময় গরম অনুভূত হবে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভয়াবহ খরায় কবলিত হয়ে মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে ভুগছে। মরু অঞ্চলের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলগুলো ক্রমান্বয়ে মরু অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। হিট ডোম-এর মতো জলবায়ু ঘটনা পূর্বেও ঘটেছে, তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি করেছে এসব ঘটনার হার ও তীব্রতা। আজ মেরু অঞ্চল হিট ডোম-এর কবলে কুপোকাত কাল হয়তো আমরা এর শিকার হবো। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রুখতে পুরো পৃথিবীর মানুষের একাত্মতা প্রয়োজন।

অর্পিতা রায় শাওন

শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়