রিটার্ন দেয়নি ৩৯ লাখ ই-টিআইএনধারী

রহমত রহমান: দেশে কর-সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, বাড়ছে করসেবার মানও। আর করদাতার মধ্যে তৈরি হয়েছে সচেতনতা। ফলে প্রতিবছরই রিটার্ন দাখিলের হার বাড়ছে। তবে ই-টিআইএন যে হারে বাড়ছে, রিটার্ন দাখিল সে হারে বাড়ছে না। ই-টিআইএনের তুলনায় অর্ধেক রিটার্নও দাখিল হয় না। ২০২০-২১ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ ৩০ হাজার। প্রায় ৩৯ লাখ ই-টিআইএনধারী রিটার্ন দাখিল করেনি। যদিও গত করবর্ষের তুলনায় এবার রিটার্ন সংখ্যা বেড়েছে ১৫ শতাংশ।

কর কর্মকর্তারা বলছেন, লকডাউন খোলার পরপরই ই-টিআইএনধারীদের নোটিশ পাঠানো শুরু করা হবে। রিটার্ন বাড়াতে এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার ফলে রিটার্ন সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। করোনার কারণে জরিপ বন্ধ রয়েছে। জরিপ আবার শুরু হলে ই-টিআইএন ও রিটার্ন দুটোই বাড়বে।

এনবিআর সূত্রমতে, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা কর দিবস অর্থাৎ ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত রিটার্ন দাখিলের সুযোগ পায়। একজন করদাতা ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর রিটার্ন দাখিল করতে পারেন। আর কোম্পানি করদাতারা ১৫ সেপ্টেম্বর ও ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত রিটার্ন দাখিলের সুযোগ পায়। যেসব কোম্পানি করদাতার আর্থিক বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর হিসাব করা হয়, সেসব কোম্পানি করদাতা ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রিটার্ন দাখিলের সুযোগ পায়। অর্থাৎ ওই কোম্পানি রিটার্ন দাখিলের জন্য ওই করবর্ষে ৯ মাস ১৫ দিন সময় পায়। আর যেসব কোম্পানি করদাতার আর্থিক বছর জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত হিসাব করা হয়, সেসব কোম্পানি ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত রিটার্ন দাখিলের সুযোগ পায়। অর্থাৎ ওই কোম্পানি ওই করবর্ষে রিটার্ন দাখিলে ছয় মাস ১৫ দিন সময় পায়। বর্তমানে সাধারণ পদ্ধতি ও সর্বজনীন স্বনির্ধারণী রিটার্ন দাখিলে এই দুটি পদ্ধতি চালু রয়েছে। ব্যক্তিশ্রেণি ও কোম্পানি করদাতারা এই দুটি পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল করতে পারেন।

আয়কর বিভাগের হিসাবমতে, চলছে করোনা মহামারি। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেড় বছর ধরে সময় সময় চলছে বিধি-নিষেধ। ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান কখনও বন্ধ, কখনও খোলা। কমেছে মানুষের আয়। অনেকে হারিয়েছে চাকরি, যার কিছুটা প্রভাব পড়েছে আয়কর আদায় ও রিটার্ন দাখিলে। মহামারির মধ্যেও রিটার্ন ও কর দুটোই মোটামুটি বেড়েছে। তবে স্বাভাবিক সময় হলে ই-টিআইএন নিবন্ধন, রিটার্ন ও কর আদায় যেকোনো সময়ের তুলনায় বাড়ত। ২০২০-২১ করবর্ষে ৩১টি কর অঞ্চলে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ২৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৪৫টি। যেখানে ২০১৯-২০ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ২১ লাখ ১৪ হাজার ৩৮৫টি। অর্থাৎ ২০২০-২১ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল বেড়েছে তিন লাখ ১৬ হাজার ২৬০টি।

হিসাবে আরও দেখা যায়, ২০২০-২১ করবর্ষে ২৪ লাখ ৮৬০টি ব্যক্তিশ্রেণির ও ২৯ হাজার ৭৮৫ কোম্পানি করদাতা রিটার্ন দাখিল করেছে। আর রিটার্নের সঙ্গে ছয় হাজার ৪১৯ কোটি টাকার আয়কর আদায় হয়েছে। যদিও বিদায়ী অর্থবছরে আয়কর আদায় হয়েছে ৮৫ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অনেক করদাতা রিটার্নের সঙ্গে কর দেন। আবার অনেক করদাতা রিটার্ন দাখিলের আগেই কর পরিশোধ করেন। কর অফিস অগ্রিম কর, উৎসে কর, বকেয়া কর, চলতি দাবি থেকে করসহ কয়েকটি পদ্ধতিতে কর আদায় করে থাকে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ই-টিআইএন নিয়েছেন ৬৩ লাখ করদাতা। আর ২০২০-২১ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ২৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৪৫টি। ৩৮ লাখ ৬৯ হাজার ৩৫৫ ই-টিআইএনধারী এবার রিটার্ন দাখিল করেননি।

কর কর্মকর্তারা বলছেন, কর শনাক্তকরণ নম্বর বা ১২ সংখ্যার ই-টিআইএন থাকলে রিটার্ন দিতে হবে। করযোগ্য আয় থাকুক আর না থাকুক রিটার্ন দিতে হবে। তবে তিন শ্রেণিতে ই-টিআইএন থাকলেও যদি করযোগ্য আয় না থাকে, তাহলে কর রিটার্ন দেয়ার দরকার নেই। যেমন অনেকে জমি বিক্রি করতে নিয়ম মেনে ই-টিআইএন নিয়েছিলেন, কিংবা টিআইএন নিয়েছিলেন ক্রেডিট কার্ড করার জন্য। করযোগ্য আয় না থাকলে তাদের আর কর রিটার্ন দেয়ার দরকার নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশে কোনো ফিক্সড বেজ বা স্থায়ী ভিত্তি নেই, এমন অনাবাসীদেরও কর রিটার্ন দিতে হচ্ছে না। এর বাইরে ২২ কারণে ই-টিআইএন নিলে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। আর যদি করদাতা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হন, তাহলে আয়কর অধ্যাদেশের ১২৪, ৭৩ ও ৭৩এ ধারা অনুযায়ী জরিমানা, ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত সুদ ও বিলম্ব সুদ আরোপযোগ্য হবে।

একাধিক কর কমিশনার শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, প্রতিটি ই-টিআইএন সংখ্যার বিপরীতে রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে এনবিআর নির্দেশনা দিয়েছে। সে অনুযায়ী সব কমিশনারেট পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রতিটি কর অঞ্চল জরিপ শুরু করে। এতে যেই বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং এর মালিককে ই-টিআইএন নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। রিটার্ন দাখিলে নোটিস করা ও কর আদায় শুরু করা হয়েছে। জরিপের ফলে নিবন্ধন ও রিটার্ন দুটিই দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করেছে। তবে করোনার কারণে জরিপ বন্ধ হয়ে গেছে। আবার ই-টিআইএন দেয়া মোবাইল নম্বরে প্রায় কর অঞ্চল থেকে রিটার্ন দাখিল করতে খুদে বার্তা দেয়া হয়েছে।

কমিশনাররা আরও জানিয়েছেন, ই-টিআইএন নিবন্ধনে দেয়া ঠিকানায় নোটিস পাঠানো হয়। কিন্তু অনেক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান চিঠি গ্রহণ করে না। কর কর্মকর্তারা সরেজমিনে গিয়ে অনেক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পান না। তবে এই হার ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। রিটার্ন দাখিল না করার শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো হলে রিটার্ন বাড়বে। তবে সব ই-টিআইএনধারীর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার ফলে রিটার্ন সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর কর অঞ্চল থেকে রিটার্ন দাখিলে আবারও পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

সূত্রমতে, বর্তমানে কোনো ব্যক্তি-করদাতার আয় যদি বছরে তিন লাখ টাকার বেশি হয়; তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, নারী ও ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সের করদাতার আয় যদি বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি হয়, গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার আয় যদি বছরে চার লাখ ৭৫ হাজার টাকার বেশি হয় এবং প্রতিবন্ধী করদাতার আয় যদি সাড়ে চার লাখ টাকার বেশি হয়, তাহলে তার রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক।