রোহিঙ্গা নিয়ে বিশ্বব্যাংক যেন ‘ধানাইপানাই’ করতে না পারে

নিজস্ব প্রতিবেদক: শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা দেশে অন্তর্ভুক্ত করাসহ বিশ্বব্যাংক যে একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব রেখেছে, সেটাকে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেয়ার ‘অভিপ্রায়’ হিসেবে দেখছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করে রোহিঙ্গাদের জন্য বাড়ি তৈরি বা শিক্ষার সুযোগের নামে বিশ্বব্যাংক যেন ‘ধানাইপানাই’ না করতে পারে সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে সতর্ক থাকতে বলেছে কমিটি।

গতকাল বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আলোচনার পর এ সুপারিশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুহম্মদ ফারুক খান জানান।

শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা দেশে অন্তর্ভুক্ত করাসহ একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাবসহ ‘রিফিউজি পলিসি রিফর্ম ফ্রেমওয়ার্ক’ নামে ১৬টি দেশের শরণার্থী ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিশ্বব্যাংক। তাতে জš§-মৃত্যু নিবন্ধন, কাজ করা, চলাফেরা, জমি কেনা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্পৃক্ত হওয়াসহ সব ধরনের আইনি অধিকার শরণার্থীদের দেয়ার কথা বলা হয়েছে।

বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা কার্যালয় থেকে ফ্রেমওয়ার্কের বিষয়ে মতামত চেয়ে ৩০ জুন অর্থমন্ত্রী বরাবর পাঠানো হয়।

পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এক অনুষ্ঠানে জানান, সরকার ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি; তারা ‘বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’।

ফারুক খান বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমরা কমিটিকে বলেছি বিশ্বব্যাংক এ ধরনের ধানাইপানাই করে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করতে চায়। রোহিঙ্গাদের সেটেলমেন্টের জন্য এটা-সেটা প্রস্তাবনা মানা যাবে না। আমরা স্পষ্টতই এর বিরোধিতা করেছি। আমরা খুব কঠোরভাবে বলেছি, বিশ্বব্যাংকের ঘাপলার চক্করে যেন আমরা না পড়ি।’

তিনি বলেন, সংসদীয় কমিটির অবস্থান হচ্ছেÑরোহিঙ্গা ইস্যুতে যে কোনো ধরনের আলোচনায় মন্ত্রণালয় যেন বলে, ‘তারা শরণার্থী নয়, বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী’। কাজেই আলোচনার প্রথম এজেন্ডা হবে তাদের কীভাবে ফেরত পাঠানো যাবে।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বলেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেছি, আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হবে, আমরা তাদের সাময়িক জায়গা দিয়েছি। আপনারা তাদের মিয়ানমারে ফেরতের ব্যবস্থা যাবতীয় করুন। আমাদের এখানে থাকার জন্য তাদের ভবন তৈরি করে দেবেন, তাদের চাকরির সুযোগ করে দেবেন, জমি কেনার সুযোগ দেবেনÑএসব ধানাইপানাই নয়। তাদের পড়াশোনার কথা বলছে। সেটা আমাদের এখানকার রোহিঙ্গাদের কেন? মিয়ানমারেই তো এখন ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে, তাদের আগে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করুন। সেখানে দুই বছর এটা চালু করলে দেখা যাবে এটার পরিণতি।’

মিয়ানমারের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন জানিয়ে ফারুক খান বলেন, ‘আমাদের পরারাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি নাকি বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তারা দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করবেন। তবে কবে নাগাদ হতে পারে তার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিশ্বব্যাংককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা আমাদের এসব টাকা দেয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে কেন? এখানে তাদের জমি কেনার কথা বলা হচ্ছে কেন? এই প্রস্তাবগুলো আপনারা মিয়ানমারকে দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, আমাদের এখানে ৯-১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, তাদের মধ্যে ৩০০ জনেরও কম আছে যারা গ্র্যাজুয়েট। তাদের তো সেই দেশেরই পড়াশোনা করার অধিকার নেই। বিশ্বব্যাংক চাইলে মিয়ানমারকে টাকা দিক, সেদেশের রোহিঙ্গাদের পড়াতে।’

বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শনে গিয়ে খুশি হয়েছেÑউল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ এ রকম করার কথা বলেছে। কিন্তু আমরা সেটা কেন করব? এখানকার জায়গা সংকটের কারণেই আমরা ভাসানচরে তাদের নিচ্ছি। তাছাড়া এটা আমাদের বনের জমি। তাদের কারণে আমাদের বন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

কভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ছোট দল জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যাবেন বলে তিনি জানান।

এদিকে রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়ন করা হলে তা এদেশে তাদের স্থায়ী বসবাসে উৎসাহিত করবে বলে বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমা দেশসমূহ ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পগুলোয় রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক্যাম্পগুলোকে জীবনমান ও সুযোগ-সুবিধাসমূহ বৃদ্ধি, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নানা বহুবার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে বেশি তৎপর হয়ে উঠছে।’

আরও বলা হয়েছে, ‘এ ধরনের কর্মকাণ্ড বিশেষত ক্যাম্পের জীবনমানের ক্রমাগত উন্নয়ন বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে বসবাসে উৎসাহিত করতে পারে এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রত্যাবাসনের স্বার্থে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জীবনমান ও সুযোগ-সুবিধাগুলো যৌক্তিক ও সীমিত পর্যায়ে রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রস্তাব করা হলে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন।’

ফারুক খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, নুরুল ইসলাম নাহিদ, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স, আব্দুল মজিদ খান ও হাবিবে মিল্লাত অংশ নেন।