ইন্ট্রাকো সোলার তিস্তা শাসন করছে

ফারুক আলম, লালমনিরহাট: ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার শৌলমারির চরে সৌরবিদ্যুতের প্রকল্পের নামে তিস্তাকে খণ্ড-বিখণ্ড করছে। নদী বুকের ১১০ একর জমি নিজেদের দখলে নিয়ে কাঁটাতারের সীমানা প্রাচীর দিয়েছে, যার মধ্যে ৪০ একর খাসজমি। প্রকল্প বাস্তবায়নে গড়ে তুলেছে বাঁধ, নদী বুকে বসিয়েছে ১৪০০ খুঁটি। এছাড়া তারা ১৮টি কালভার্ট ও দুটি স্টিলের ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।

ইন্ট্রাকোর নদী বিধ্বংসী প্রকল্প ঘুরে দেখার পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দা, দপ্তর ও নদী গবেষকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হয়।

প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, বিচিত্র সব কর্মযজ্ঞ। সেখানে ছবি ও খবর সংগ্রহের জন্য গেলে কর্তৃপক্ষ বারবার বাধা দেয়। সেখানে তাদের নিজেদের নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র।

তিস্তায় সারি সারি খুঁটি, সোলার প্যানেল ও জমির ওপর বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে লেখা আছে বায়না সূত্রে জমির মালিক ইন্ট্রাকো সোলার লিমিটেড। সাইনবোর্ডে লেখা নেই জমির পরিমাণ, দাগ ও খতিয়ান।

প্রায় সাত মাস ধরে নদী শাসন করা এ প্রকল্পের সঠিক কোনো তথ্য দপ্তরের কাছে নেই। নদীসংশ্লিষ্ট জেলার দপ্তরগুলো বলছে, তাদের না জানিয়ে ইন্ট্রাকো তাদের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ইন্ট্রাকোর করা প্রকল্পের কারণে স্থানীয়রা তাদের দুঃখ ও দুর্দশার কথা বারবার জানাচ্ছেন। তারা আশঙ্কা করছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তাদের জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তীব্র থেকে তীব্রতর হবে নদী ভাঙন। হাজার বিঘা জমি নদীতে বিলীন হবে। কৃষিসহ ধ্বংস হবে স্বাভাবিক জীবনমান।

স্থানীয়রা জানান, উজানের সাতটি ইউনিয়নে ভাঙনসহ ভাটি ও প্রকল্প এলাকায়ও সৃষ্টি হয়েছে বিরুপ প্রভাব। ইন্ট্রাকোর সম্পূর্ণ প্রকল্প করা হয়েছে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করে।

স্থানীয় বাসিন্দা মমিনুর রহমান (৪০) বলেন, এবার পানি কম, তাই বোঝা যাচ্ছে না। পানি বাড়লে ফসলের ক্ষতি হবে, নদী ভাঙবে।

আরেক বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম (৪৫) বলেন, আমার জমির ওপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করেছে। ১৫ শতাংশ জমি রাস্তায় চলে গেছে। এই জমির টাকা কোনোদিন দেবে, না কি দেবে না, কিছুই বলে না।

অনেকে বলেন, জমি দখলে নিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। জমিজমার টাকাও ঠিকমতো দেয় নাই। কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার পরে এদিক দিয়ে যাতায়াত করতে দেয় না। চরে গরু ছাগল নিয়ে এলেই বের করে দেয়। এই যে সড়ক বানিয়েছে, তাতে আমাদের কোনো লাভ নেই। এ সড়কের কারণে নদীভাঙন দেখা দেবে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, যে জমি নদীর হয়ে উঠেছে, সে জমি ব্যক্তির হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে নদীর মাধ্যমে গড়ে উঠা প্রকল্প ১০০ ভাগ অবৈধ। আড়াআড়িভাবে যে সড়ক তৈরি হয়েছে, তাতে নদীর সর্বনাশ হবে। নদী পাড়ের মানুষের সর্বনাশ হবে। সরকার যখন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তিস্তাকে ঘিরে, তার ভেতরে নদীর মধ্যে আগাম প্রতিষ্ঠান করা অন্যায়। এটা এখনই বন্ধ করা উচিত। উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও এ সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, নদীর বুক বন্ধ করে পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হলে পানি যাবে কোনদিক দিয়ে? কিনার দিয়ে যাবে, ভাঙন হবে। ওই অঞ্চলের সাতটি ইউনিয়নের জনগণ, সাতটি ইউনিয়ন আবারও নদীতে চলে যাবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, এর বিস্তারিত তথ্য জানতে পারিনি। তারা কোনো স্টাডি ও ছাড়পত্র আমাকে দেখাতে পারেনি। জেলা পানিসম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা কমিটিকে জানিয়েছি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসনকে রিপোর্টিং করেছি। আমি  যে ক্ষয়ক্ষতির কথা বলেছি তার আলামত শুরু হয়েছে।

ডিসি আবু জাফর বলেন, খাসজমির বিষয়ে একটা আবেদন করেছে। সেটা ভূমি মন্ত্রণালয় দেখবে। সড়ক ও ব্রিজ নিয়ে আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি। কমিটি সরেজমিন প্রতিবেদন দিলে আমরা ব্যবস্থা নেব।

এ বিষয়ে বারবার ইন্ট্রাকোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তারা বক্তব্য দেয়নি। প্রকল্প তত্ত্বাবধায়ক আজিজ বাবুর বক্তব্য নিতে গেলে, তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি চান। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকায় তিনি কথা বলেননি।

ইন্ট্রাকোর প্রকল্প পরিচালক আব্দুল হালিমও বক্তব্য দেবেন না বলে জানান।