হিসাবে কারসাজির মাধ্যমে কর ফাঁকিতে নভো নরডিস্ক

রহমত রহমান: ডেনমার্কের ওষুধ কোম্পানি নভো নরডিস্ক ফার্মা প্রাইভেট লিমিটেড দেশের দুটি কোম্পানির মাধ্যমে ওষুধ বাজারজাত করে। এছাড়া অন্যান্য দেশীয় ওষুধ কোম্পানির মতো নিজস্ব চ্যানেলে সারাদেশে ওষুধ বাজারজাত করে আসছে। তবে কোম্পানিটি ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ হারে গ্রস প্রফিট বা মোট মুনাফা (জিপি) কম দেখিয়ে এ দেশে ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে। অথচ সমজাতীয় দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রদর্শিত জিপি হার ৫০ শতাংশেরও বেশি।

দেশের ইনসুলিন মার্কেটের প্রায় ৮০ শতাংশ এই কোম্পানির দখলে রয়েছে। এরপরও কোম্পানিটি বিভিন্ন করবর্ষে জিপি দেখিয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ! অথচ সমজাতীয় দেশি-বিদেশি কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির (যেমন ভারতীয় মালিকানাধীন কোম্পানি সান ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লি., রেনাটা লিমিটেড ইত্যাদি) প্রদর্শিত গ্রস প্রফিটের হার শতকরা ৫০ ভাগের ওপরে। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানিটি করফাঁকি দিতে উৎপাদনের তথ্য গোপন করে জিপি এত কম দেখিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। 

আয়কর অফিস সূত্রে জানা গেছে, নভো নরডিস্ক কোম্পানিটি কখনোই তাদের সামগ্রিক লেনদেনের যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য সরেজমিন সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিদর্শন করার সুযোগ দেয়নি। প্রতিষ্ঠানটি কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদনের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সব সময় গোপন করে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানিটি টঙ্গী-গাজীপুরে এশিয়ার তৃতীয় বৃহৎ ইনসুলিন প্লান্ট স্থাপন করেছে। এই প্লান্ট স্থাপনে কত টাকা বিনিয়োগ করেছে, তা কোম্পানির দাখিল করা অডিট রিপোর্টে না দেখিয়ে কর ফাঁকি দিতে গোপন করেছে।

সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি ‘ফার্মা মিরর’ নামে আন্তর্জাতিক একটি মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠানটির ইনসুলিন প্লান্ট স্থাপনের তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর কর অফিস বিষয়টি জানতে পেরেছে। যাতে বলা হয়েছে, নরডিস্ক-এসকায়েফ প্লান্ট বছরে ৫০ লাখ ইনসুলিন শিশি (ভায়াল) বাংলাদেশে বাজারজাত করছে। অথচ এরূপ ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টে বিনিয়োগ তথ্যসংশ্লিষ্ট আয়কর অফিস এতদিন জানত না। 

আয়কর অফিসে ওষুধ কোম্পানিগুলোর জমা দেয়া রিটার্নে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ করবর্ষে বেশিরভাগ ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী কোম্পানি জিপি রেইট দেখিয়েছে গড়ে ৩০ থেকে ৫১ শতাংশ। আর লাভ করা সত্ত্বেও নভো নরডিস্ক জিপি দেখিয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ! মুন্দি ফার্মা বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড ভারতের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। ছোট এই কোম্পানি ওই করবর্ষে জিপি দেখিয়ে ৩১ দশমিক ৮১ শতাংশ। বিদেশি সান ফার্মাসিউটিক্যাল (বাংলাদেশ) লিমিটেড জিপি দেখিয়েছে ৫১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অথচ দেশের বাজারে এ দুই কোম্পানি অল্প কিছু ওষুধ বাজারজাত করে থাকে। ওই করবর্ষে সান ফার্মাসিউটিক্যাল (বাংলাদেশ) লিমিটেড সব ওষুধ কোম্পানির মধ্যে সর্বোচ্চ গ্রস প্রফিট দেখিয়েছে।

হিসাবে আরও দেখা যায়, দেশীয় কোম্পানি এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের জিপি রেইট দেখানো হয়েছে ৪৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। এছাড়া এক্মি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ ও নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ৪৪ দশমিক ৯০ শতাংশ জিপি রেইট দেখিয়েছে। ওই করবর্ষে সবচেয়ে জিপি দেখিয়েছে পপুলার, ইনসেপ্টা ও রেনাটা লিমিটেড। এর মধ্যে পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস ৫০ দশমিক ৬১ শতাংশ, ইনসেপ্টা ৫০ দশমিক ৫০ শতাংশ ও রেনাটা ৫০ দশমিক ২০ শতাংশ জিপি রেইট দেখিয়েছে। এছাড়া রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস জিপি দেখিয়েছে ৪৯ দশমিক ৯০ শতাংশ।

আয়কর অফিস সূত্রমতে, নভো নরডিস্ক ফার্মা ২০১৮-১৯ করবর্ষে মোট আয় দেখিয়েছে ১৩ কোটি ২৪ লাখ ৮ হাজার ৬৯ টাকা। ওই করবর্ষে মোট রেভিনিউ দেখানো হয়েছে ১৭১ কোটি ৬৫ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৭ টাকা। আর প্রতিষ্ঠানটি জিপি দেখিয়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ২৫ হাজার ৬৬ টাকা। গ্রস মুনাফার হার দেখানো হয়েছে ১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ! প্রতিষ্ঠানটি কর ফাঁকি দিতেই মূলত জিপি এত কম দেখিয়েছে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। তবে তদন্তে ওই করবর্ষে করযোগ্য আয় বেরিয়েছে ১৮৪ কোটি ৩৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৫ টাকা।

এনবিআর সূত্রমতে, নভো নরডিস্ক কাঁচামালের বিপরীতে উৎসে কর কর্তন করে না। এছাড়া আরও কয়েকটি খাতে সঠিকভাবে কর কর্তন ও সরকারি কোষাগারে জমা দেয় না। স্থানীয় রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর নভো নরডিস্কের বিরুদ্ধে এনবিআরে দুটি প্রতিবেদনে দিয়েছে। যাতে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ করবর্ষে ৮৪ কোটি ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার ৩০০ টাকার বিপরীতে ৫ শতাংশ হারে ২৯ কোটি ৫৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৫৫ টাকা কর কর্তন করা হয়নি। এছাড়া ২০১৯-২০ করবর্ষে ২০ কোটি ৮২ লাখ ৫ হাজার ৩৯৭ টাকার বিপরীতে ৭ কোটি ২৮ লাখ ৭১ হাজার ৮৮৯ টাকা কর কর্তন ও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি। অডিট অধিদপ্তর ব্যবস্থা নিতে বললেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, স্থানীয় রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী শেয়ার বিজ পত্রিকায় চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘বহুজাতিক নভো নরডিস্ক কর দেয়নি ৩০ কোটি টাকা’ এবং ৯ মার্চ ‘আয় গোপন করে নভো নরডিস্কের কর ফাঁকি’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদন প্রকাশের পরও কর অফিস এই কর আদায় এবং সংশ্লিষ্ট করবর্ষের আয়কর মামলা পুনঃউম্মোচন করেনি বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে কোনো বিদেশি ওষুধ কোম্পানি এই ফর্মুলায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পাদন করে না বলে এ খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

অন্যদিকে, নভো নরডিস্ক ফার্মায় এর আগে ইন্টার্ন করা এক ছাত্রের ইন্টার্নশিপ প্রতিবেদন এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। যেখানে কোম্পানির দায়িত্ব ও কর্তব্যের অর্গানোগ্রামটি পর্যালোচনা করলে দেখা গেছে, নভো নরডিস্ক এ দেশে পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত সব ধরনের কার্যক্রম সম্পাদন করে। অথচ কোম্পানির নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণীতে ওষুধ উৎপাদনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কোম্পানি দাবি করে, তারা এসকায়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে সেটা কোনোরূপ প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াই (যেহেতু কোম্পানিটি অডিটেড হিসাব বিবরণীতে উৎপাদন প্লান্টের অস্তিত্বেরর বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি) ট্রান্সকম ডিস্ট্রিবিউশন এবং বারডেমের কাছে বিক্রি করে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভারত, চীন, ব্রাজিল, ডেনমার্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নভো নরডিস্কের ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট রয়েছে। চাইলে এদেশীয় নভো নরডিস্ক সরাসরি এসব প্লান্ট থেকে ওষুধ আমদানি করে তা বিক্রি করতে পারত। এ দেশে কোম্পানিটির পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য কেন অতিরিক্ত একাধিক ব্যবসায়িক সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করছে এই প্রশ্নের উত্তরে আয়কর আইনজীবী ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের মতে, একই পণ্যের বিক্রয়মূল্য থেকে একাধিকবার একই ধরনের খরচ একাধিকবার চার্জ করে নিট করযোগ্য মুনাফা কম প্রদর্শন করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। এদেশীয় নভো নরডিস্ক কোম্পানি একই কৌশলে তাদের বিক্রয়ের সব সেটআপ থাকা সত্ত্বেও বিক্রয় কার্যক্রমে একাধিক পক্ষকে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করে এবং কীভাবে মনোপলি সুবিধায় একই পণ্য অন্য দেশের তুলনায় এ দেশে বেশি দামে বিক্রি করেÑসে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।

নভো নরডিস্কের জিপি রেইট, ইনসুলিন প্লান্ট, পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ, কর কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরি ও অফিস পরিদর্শন করতে না দেয়া, একই পণ্যে একাধিকবার খরচ দাবিসহ কয়েকটি বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানের কমিউনিকেশনের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা নাজমুল হাসান মাহমুদের (মার্কেট অ্যাকসেস প্রজেক্ট ম্যানেজার) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরে ১ আগস্ট ই-মেইলে প্রতিষ্ঠানকে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয়। ১২ আগস্ট কোম্পানির পক্ষ থেকে ই-মেইলে জবাব পাঠানো হয়। তবে নভো নরডিস্কের পাঠানো লিখিত জবাবে বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়নি।

লিখিত জবাবে বলা হয়, ‘ডেনমার্কভিত্তিক নভো নরডিস্ক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইনসুলিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, যা পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৩২.৮ মিলিয়ন রোগীকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেবা দিয়ে আসছে। সারাবিশ্বে ডেনমার্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রাজিল এবং চীনে নভো নরডিস্কের নিজস্ব ইনসুলিন উৎপাদন কারখানা রয়েছে এবং এসব দেশে নিজস্ব মালিকানায় ও তত্ত্বাবধানে উৎপাদন পরিচালিত হয়ে থাকে। নভো নরডিস্ক টঙ্গী-গাজীপুরে বা বাংলাদেশের অন্য কোনো স্থানে ইনসুলিন প্রস্তুতকারী কারখানার মালিক নয় এবং উৎপাদন পরিচালনা করে না।’

আরও বলা হয়, ‘আমরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল সর্বোচ্চ ব্যবসায়িক নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করি, যার মধ্যে ট্যাক্স, ভ্যাট এবং কাস্টমস আইন অন্যতম। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অ্যাকাউন্টিং নীতি অনুসরণ করি, যেখানে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়ার সুযোগ নেই। আমাদের অ্যাকাউন্টিং রেকর্ডগুলো বিখ্যাত অডিট সংস্থাসমূহ দ্বারা নিরীক্ষণ করা হয়। প্রতিটি লেনদেনের জন্য আমাদের কাছে সহায়ক নথি রয়েছে, যা আর্থিক বিবরণীর নিরীক্ষণের সময় এবং করপোরেট ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের সময় জমা দেয়া হয়।’