নিষেধাজ্ঞা নেই, কভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সচেতনতার বিকল্প নেই

লুৎফর রহমান লাভলু: পৃথিবীর রূপ আজ স্বাভাবিক নেই। কভিড মহামারিতে বিপর্যস্ত সারাবিশ্ব। পরিবার, সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র এবং জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক সব স্তরে বিরাজ করছে স্থবিরতা। গত বছর মার্চ মাস থেকে শুরু হয় আমাদের দেশে কভিডের সংক্রমণ। ধীরে ধীরে আক্রমণ বাড়তেই থাকে করোনাভাইরাসের। করোনার প্রকোপ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকলে সরকার বাধ্য হয় লকডাউন দিতে, যা আমাদের মতো সদ্য উন্নয়নশীল দেশ ও মানুষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পর থেকেই দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সরকার দফায় দফায় বাড়াতে থাকে লকডাউন। করোনা প্রকোপের প্রাথমিক পর্যায়ে রাজধানী থেকে শুরু করে প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত সব মানুষ সচেতনতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, যা একপ্রকার আতঙ্কের মতো জনসমাজে প্রভাব বিস্তার করে।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও যেহেতু অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন নয়, তাই তারা সময়ের পরিক্রমায় আস্তে আস্তে করোনা মহামারি সম্পর্কে অসচেতন ও উদাসীন হয়ে নিজের মনমতো যত্রতত্র ঘোরাফেরা করছে। আর বাস্তবিক পক্ষেই যেহেতু আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দিনমজুর এবং খেটে খাওয়া শ্রমিক ও কৃষক, তাই তারা পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ মেটাতে বাধ্য হয় সরকারের দেয়া লকডাউন ভেঙে বেরিয়ে আসে উপার্জন করতে। চলতি বছরের প্রথম দিকে করোনার প্রভাব হ্রাস পেলে লকডাউন তুলে নেয় সরকার। সব পরিবহন, অফিস-আদালত, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি খুলে দেয় সরকার সাধারণ মানুষের ভোগান্তি রোধে। কিন্তু গত দুই মাস থেকে আবারও কভিডের আক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়ায় মৃত্যুর হারও সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়তে থাকে। এর অন্যতম কারণ মানুষের অসচেতনতা ও উদাসীনতা। প্রয়োজনে হোক আর অপ্রয়োজনে হোক সবাই তার ইচ্ছামতো ঘোরাঘুরি, আড্ডা, জনসমাগম ও গা ঘেঁষাঘেঁষি করছে হররোজ। গাড়িতে, দোকানে, বাজারে কিংবা মার্কেটে মানুষের মাঝে নেই শারীরিক দূরত্ব, মাস্ক কিংবা স্যানিটাইজারের ব্যবহার, সর্বোপরি সচেতনতার রেশ মাত্র পাওয়া যায় না মানুষের মাঝে। অথচ করোনার ব্যাপকতর আক্রান্ত ও মৃত্যুসংখ্যা দেখে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়ার কথা। এখন প্রতিদিন মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ আর আক্রান্তও হচ্ছে দ্বিগুণ। পক্ষান্তরে আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ততটা উন্নত নয়, যতটা থাকার কথা একটি উন্নয়নশীল দেশের। আমাদের জনসংখ্যা অনুপাতে পর্যাপ্ত হাসপাতাল নেই, বেড নেই, অক্সিজেন নেই, অ্যাম্বুলেন্স নেই এবং নেই আইসিইউর সঙ্গে উন্নত চিকিৎসা। শুধু তা-ই নয়, যত্রতত্র বেসরকারি হাসপাতাল ও ডাক্তার থাকলেও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাব পরিলক্ষিত হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে অক্সিজেনের অভাবে অনেক রোগী মারা গেছে। অন্যদিকে আমাদের অর্থনীতি করোনাকালে একেবারে ভেঙে পড়েছে। সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক ও ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের ঘরে খাবার নেই। দেশের সরকারের একার পক্ষে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এ যেন উভয় সংকটÑএকদিকে করোনার ভয়ংকর ছোঁয়া, অন্যদিকে মানুষের ঘরে খাবার নেই। সবদিক বিবেচনা করে ১১ আগস্ট  থেকে লকডাউন শিথিল করে দেয়া হয়েছে। অফিস-আদালত, হাটবাজার ও পরিবহন চলবে আগের মতো স্বাভাবিক গতিতে। পরিবহন ভাড়াও আগের মতো করেছে সরকার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে। বর্তমানে সব শিক্ষার্থীসহ সর্বসাধারণের টিকা নিশ্চিত করার জন্য ইউনিভার্সিটিগুলোয় ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নিবন্ধন করতে বলেছেন সরকার। টিকা নিশ্চিত হলেই খোলা হবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাতে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুঝুঁকি কমবে, এটা অনেকটা নিশ্চিত বলা যায়। আর শিক্ষার্থীদের সেশনজট রোধে অনলাইন পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে প্রতিষ্ঠান। গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। এদিক বিবেচনা করে গ্রামাঞ্চলের সব মানুষের পাশাপাশি শহরাঞ্চলের সব মানুষকে আরও বেশি সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।

লকডাউন ও শাটডাউনের বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়েছে সরকার দেশের সার্বিক দিক বিবেচনা করে। বিধিনিষেধ উঠে গেছে, নেই লকডাউন। তার মানে এই নয় যে, করোনা বিদায় নিয়েছে। এই মুক্ত ও স্বাধীন জীবনে আমাদের আরও বেশি সচেতন ও দায়িত্ববান হতে হবে। করোনার প্রভাবে অনির্দিষ্টকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে ঝরে গেছে অনেক শিক্ষার্থীর জীবন, যা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়নে একটা বড় বাধা। অনেকের আবার সরকারি চাকরির বয়স পার হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকারের ঘনঘটা। তারা বাধ্য হয়েই চাকরির বয়স বৃদ্ধির আন্দোলন করছে। দেশের এমন প্রতিকূলতা দেখে সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালক, পরিবহনচালক, ক্ষুদ্র, মাঝারি, বৃহৎ ব্যবসায়ী ও শিল্প প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি ছাত্র ও শিক্ষক সর্বোপরি সবার দিক বিবেচনা করে ধাপে ধাপে টিকার ব্যবস্থা করে সবকিছু স্বাভাবিক করতে চাচ্ছে সরকার। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও ভেঙে পড়া অর্থনীতিতে আবারও এগিয়ে নিতে লকডাউন উঠিয়ে নেয়া সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত এবং সবার জন্য কল্যাণকর তখন হবে যখন আমরা নিজ থেকে দায়িত্বশীল ও আরও সাবধানতা অবলম্বন করব। পাশাপাশি অন্যদের সচেতন ও দায়িত্বশীল করে তুলব। শহর কিংবা গ্রামে সব মানুষেকে অবশ্যই ঘর থেকে বেরুনোর সময় সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। মাস্ক পরতে হবে, পকেটে স্যানিটাইজার বা সাবান রাখতে হবে, যাতে দুই হাত সবসময় জীবাণুমুক্ত রাখা যায়; কেননা করোনাভাইরাস হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়।

আমরা ভৌগোলিকভাবেই বেশি সময় জ্বর, ঠাণ্ডা ও কাশিতে আক্রান্ত হয়ে যাই, ফলে সবসময় আমাদের হাত নাক ও মুখে দিয়ে থাকি। তাই হ্যান্ডশেক, গা-ঘষাঘষি আর এড়িয়ে চলতে হবে জনসমাগম। হাত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করে নাকে ও মুখে হাত দেয়া যাবে না। অপর মানুষ থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বাইরে কোনো কাজ শেষ করে ফিরতে হয় আমাদের পরিবারের কাছে, তাই এসেই কাউকে না ধরে পরিচ্ছন্ন হয়ে তারপর মিশব সবার সঙ্গে। কেননা আপনার কারণে যেন পরিবারের কেউ করোনার ঝুঁকিতে না পরে। পাশাপাশি আমাদের সবাইকে সামর্থ্য অনুপাতে ভিটামিন সি ও ডি-সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যেমনÑপানি, স্যালাইন, লেবুর শরবত, ফলের রস, দুধ, বাদাম, ডাব, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি। এর ফলে আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তাহলে সহজে কোনো রোগ আমাদের আক্রান্ত করতে পারবে না। যাদের শরীরে দীর্ঘ মেয়াদে জ্বর, শরীরব্যথা, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হয়, তাদের আতঙ্কিত না হয়ে অতিদ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং করোনা টেস্ট করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শে প্রয়োজন হলে ১৪ দিন একা জীবনযাপন করতে হবে।

একটি বিষয় আমাদের সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করতে হবেÑযেখানে সরকার লকডাউন দিয়ে মানুষের জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিল, তারপরেও প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুহার ছিল অনেক বেশি; সেক্ষেত্রে এখন সরকারের  নিষেধাজ্ঞা নেই, মানুষ দৈনন্দিন জীবনযাপনে এখন স্বাধীন ও মুক্ত। তাই আমাদের এখন আরও বেশি দায়িত্ববান হতে হবে এবং সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে আমাদের অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ না করে। সরকার জনগণের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যে গণটিকা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, আমাদের প্রত্যেককে এই টিকা নিতে হবে। করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের আতঙ্ক নয়, বরং সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। সচেতনতাই পারে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে। পরিশেষে বলতে হয়, নিষেধাজ্ঞা নেই, দায়িত্ব আছে। আমরা যদি সচেতন হই, তাহলে আমরা প্রত্যয়ীভাবে বলতে পারি, ‘করোনা মোরা করব জয়।’

 শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা কলেজ