হেফাজত আমির জুনাইদ বাবুনগরীর মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক: সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনায় আলোচনায় থাকা ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় আমির জুনাইদ বাবুনগরী মারা গেছেন।

অসুস্থ অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার তাকে চট্টগ্রাম শহরের সেন্টার ফর স্পেশালাইজড কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ (সিএসসিআর) হাসপাতালে নেয়া হলে বেলা পৌনে ১টায় চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস নদভী জানান।

তিনি জানান, তাদের আমির রাত থেকেই অসুস্থ বোধ করছিলেন। সকালে পরিস্থিতি গুরুতর হলে তাকে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ের ওই হাসপাতালে নেয়া হয়, কিন্তু বাঁচানো যায়নি।

হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রভূমি হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসার শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা পরিচালক বাবুনগরীর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। তিনি হƒদরোগসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তিনি স্ত্রী, পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন।

গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর ওই মাদরাসার দীর্ঘদিনের মহাপরিচালক এবং হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে সংগঠনের নেতৃত্বে আসেন জুনায়েদ বাবুনগরী। ১১ মাসের মাথায় তারও জীবনাবসান ঘটল।

অনুসারীদের কাছে জুনায়েদ বাবুনগরী ছিলেন একজন ‘অসাধারণ’ ইসলামপন্থি এবং ‘গতিশীল ও উদ্যোগী’ নেতা। তবে বিরোধীরা সংগঠনকে ‘ভুল পথে’ নেয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন তার বিরুদ্ধে।

শফীর সময়ের শেষ দিকে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের যে সখ্য দেখা যাচ্ছিল, বাবুনগরী দায়িত্ব নেয়ার পর সেখানে তৈরি হয় দূরত্ব। তার সময় গত বছরের শেষ দিকে ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনে নেমে নতুন করে আলোচনায় আসে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।

গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর ঘিরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক দিন ধরে তাণ্ডব চালায় কট্টর ভাবধারার এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সেসব ঘটনায় কয়েকটি মামলায় বাবুনগরীকেও আসামি করা হয়।

আহমদ শফীর মৃত্যু ‘স্বাভাবিকভাবে হয়নি’ বলে দাবি করে তার শ্যালকের করা মামলায়ও আসামি ছিলেন জুনাইদ বাবুনগরী। পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বাবুনগরীসহ ৪৩ জনের ‘দায়’ পাওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

বাবুনগরী অবশ্য ওই তদন্ত প্রতিবেদনকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, আহমদ শফীর ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যু হয়েছে।

হেফাজতে ইসলামের নেতাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার বাবুনগর গ্রামে জুনাইদ বাবুনগরীর জš§।

১৯৭৬ সালে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করে তিনি করাচিতে জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তাখাচ্ছুছাত ফিল উলুমুল হাদিস মাদরাসায় উচ্চশিক্ষা নেন। ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়।

পরে তিনি হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষা সচিব ও শায়খুল হাদিস, কওমি মাদরাসার একটি বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহসভাপতি এবং চট্টগ্রাম নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া নাজিরহাট বড় মাদরাসার মুতাওয়াল্লি এবং মাসিক মুখপত্র দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন তিনি।

শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে কওমি মাদরাসাভিত্তিক ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যাত্রা হয়, যাতে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও যুক্ত হয়। বলা হয়, বাংলাদেশে ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠাই হেফাজতের আন্দোলনের লক্ষ্য।

নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার ২০১১ সালে ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ ঘোষণা করলে তার বিরুদ্ধে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। মূলত তখন থেকেই এ সংগঠন সারাদেশে পরিচিতি পায়।

পরে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে সেই আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক ব্লগার’ আখ্যায়িত করে তাদের শাস্তির দাবিতে সক্রিয় হয় কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠনটি।