নাজমুন নাহার জেমি: বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার কাটিয়ে নারীরা আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছেন। কিন্তু পথে-ঘাটে,বাসে-ট্রেনে এমনকি বাসা, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা বা কর্মস্থলে শিশু ও নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন। সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষতায় এসে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের নারীরা প্রতিদিনই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, এটা বড়ই দুঃখজনক। নারী ধর্ষণ বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে গেছে। দু-চারজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাছাড়া যেসব মামলা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রে এমন দুর্বলভাবে সাজানো হয় যে অপরাধীরা শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়ে যায়। সেসব অপরাধী ফিরে এসে নির্যাতিত নারীর মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনকে হুমকি দেয়। নারী নির্যাতন রোধে অনেক আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ দুর্বল। শুধু আইন থাকলেই নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা যাবে না বরং আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি। বিচারহীন বা ন্যায়বিচারের অভাবে একটি সমাজ ধীরে ধীরে অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠে। এ প্রবণতা দূর করতে হলে সর্বাগ্রে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং সেই সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিচারহীনতা নারীর প্রতি সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয়ার সমতুল্য।
এক সময় নারীরা দিনের পর দিন নির্যাতন সহ্য করে যেতেন। এখনও সে অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এখনও নিয়মিত ঘটনা। ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী পাচারের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের শনাক্ত করা গেছে, তাদের ৭০ শতাংশই ছিল নারী এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যৌন শোষণের কারণে তারা পাচারের শিকার হয়। ২০০৯ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কার্যকর ব্যবস্থা করতে হবে। নারী ও শিশুর ওপর ধর্ষণ এবং সব ধরনের যৌন সহিংসতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের মতো নারী ও শিশুর ওপর ধর্ষণ এবং নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আইন ও নারী নির্যাতনবিরোধী আইনকে সংশোধন করে সময়োপযোগী করতে হবে। বর্তমান সরকার নারীদের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে ও নির্যাতিত নারীদের জন্য ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার খোলা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে প্রতিটি নারী ও শিশু নির্যাতনের ন্যায্য বিচার করতে হবে এবং বিশেষ বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা পরিচালনার প্রতি জোর গুরুত্ব দিতে হবে। নারী ও শিশু ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা ও পারিবারিক নির্যাতন বন্ধে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।
আইন থাকা সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান হারে নারী নির্যাতন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে প্রণীত আইনগুলোর বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতা ও আইনের প্রয়োগ-পদ্ধতিতে কোনো ত্রুটি। যৌতুকের দাবি ও যৌতুকের জন্য নির্যাতনের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকায় ১৯৮০ সালে প্রণীত হয় যৌতুক নিরোধ আইন। পাশাপাশি নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ২০০০ সালে প্রণীত হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। এমআইসিএস ২০১৯-এর তথ্য মতে, ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের ৩৭ শতাংশ সন্ধ্যার পর একা চলাফেরার ক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করে না। বাংলাদেশে ১৫-৪৯ বছর বয়সী প্রতি চারজন নারীর একজন (২৫.৪ শতাংশ) নি¤েœাক্ত পরিস্থিতিগুলোর যে কোনো একটি তৈরি হলে স্বামীর দ্বারা স্ত্রীকে প্রহার করা ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করেন; ১. স্বামীকে কিছু না জানিয়ে ঘরের বাইরে গেলে, ২. সন্তানদের অবহেলা করলে, ৩. স্বামীর সঙ্গে তর্ক করলে। পরিস্থিতি যে ভয়াবহ মাত্রায় গেছে, যেভাবে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, আইনের কড়াকড়ি না থাকলে এর প্রতিকার পাওয়া যাবে না। সুনির্দিষ্ট বিধান ছাড়া অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা কঠিন। প্রয়োজনে বিদ্যমান আইনে যৌন হয়রানির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিয়ে বিভিন্ন ধারায় বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির আইন ও বিধিমালা জারি করা হোক। না হলে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী শুধু নির্যাতিতই হবে না, ওরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে থেকে যাবে।
নারী যেকোনো স্থানে নির্যাতন বা হুমকির মুখে পড়লে ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়ে তাৎক্ষণিক ভিত্তিতে প্রতিকার পেতে পারে। ৩৩৩ ও ১০৯ নম্বরেও হেল্পলাইন আছে। এই তিনটি নম্বরেও হেল্পলাইন আছে। এই তিনটি নম্বরের যে কোনোটিতে কল দিলে একসঙ্গে তিন জায়গাতেই যাবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা আছে। সরকারের পক্ষ থেকে হয়রানি মোকাবিলার জন্য একটি ডিজিটাল ব্যবস্থা হিসেবে ‘জয় মোবাইল আ্যাপ’ চালু করেছে। এই আ্যাপ ডাউনলোড করে মোবাইলে রাখলে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ এই অ্যাপে চাপ দিলেই সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোবাইলের ক্যামেরা অন হয়ে যায় এবং যৌন হয়রানির সঙ্গে জড়িতদেরসহ চারপাশের ছবি ওঠে, পুলিশসহ সবখানে বিপন্ন নারীর খবর পৌঁছে যায়। জিপিএসের মাধ্যমে হয়রানির শিকার নারীর অবস্থানও তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করা যায়।
নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার প্রত্যাশিত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। নারীর হয়তো ক্ষমতায়ন হচ্ছে কিন্তু নারীর সমতায়ন হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ। প্রতিনিয়ত ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটছে, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশু কিন্তু নির্যাতকরা পার পেয়ে যাচ্ছে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করতে পারি। প্রতিটি দিন হোক নারী নির্যাতনমুক্ত। আমরা আর সহ্য করব না, সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করবই এবং কোনোভাবেই এই অন্যায় মেনে নেব না। সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, জোরালো অবস্থান নিতে হবে এবং আওয়াজ তুলতে হবে। যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ নারীর জন্য লজ্জার বিষয় নয় বরং এ লজ্জা নির্যাতনকারী ও ধর্ষণকারীর।
শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়