জয়নাল আবেদিন: করোনায় ব্যাংক খাতের ঋণ আদায়ের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও নিয়মিত ঋণ থেকে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি পাঁচটি ব্যাংক। আরও তিন ব্যাংকের আদায় এক শতাংশেরও নিচে। করোনার সুযোগ নিয়েই এমনটি করেছেন অনেক ব্যবসায়ী। ফলে একদিকে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি, অন্যদিকে আদায়ের নিম্নগতি ব্যাংক খাতকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে মত বিশ্লেষকদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কার্যরত ব্যাংকগুলো অভ্যন্তরীণভাবে ১০ লাখ ১৯ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। বিশেষ ছাড়ে নিয়মিত থাকা এসব ঋণের বিপরীতে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) আদায় হয়েছে মাত্র ১৭ দশমিক সাত শতাংশ, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ এক লাখ ৮০ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। তবে আলোচ্য সময়ে ঋণ বিতরণ করলেও এক টাকাও আদায় করতে পারেনি পাঁচ ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ইউনিয়ন ও কমিউনিটি ব্যাংক। এর বাইরে নামমাত্র আদায়ে সক্ষম হয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। জুন শেষে ব্যাংকটির নিয়মিত ঋণ থেকে আদায়ের হার শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ। এছাড়া আইএফআইসি ব্যাংকের আদায়ের হার শূন্য দশমিক ৩০ ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের আদায়ের হার শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘জুন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ছিল। কিস্তির ২৫ শতাংশ দিলেই গ্রাহককে নিয়মিত রাখার নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কোনো টাকাই পরিশোধ করেনি আমাদের গ্রাহক। সুযোগ নিয়েছে সবাই। ফলে জুনে রিকভারির হার শূন্য শতাংশ। একই অবস্থা অন্যান্য ব্যাংকেও।’
এদিকে খেলাপি গ্রাহকদের থেকে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি এমন ব্যাংকের সংখ্যা চারটি। এর মধ্যে রয়েছে সিটিব্যাংক এনএ, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, এইচএসবিসি ও উরি ব্যাংক। এগুলোর সবকটিই ছিল দেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংক। এর বাইরে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি গ্রাহক থেকে আদায়ের চিত্র খুবই করুণ ১৯ ব্যাংকের। এগুলোর আদায়ের হারও এক শতাংশের নিচে। সবমিলিয়ে খেলাপি গ্রাহক থেকে ২৩টি ব্যাংকের আদায়ের হার শূন্য থেকে এক শতাংশের মধ্যে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুন শেষে ব্যাংক খাতের অভ্যন্তরীণ মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো আদায় করতে সক্ষম হয়েছে এক হাজার ৭৯৫ কোটি। সুতরাং সার্বিক আদায় হার এক দশমিক ৮৯ শতাংশ। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাকালে ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছিল। সেই সুযোগে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কিস্তি শোধ করেনি অনেকে। তবে চলতি বছরে কিছু টাকা আদায় হয়েছে, যার পরিমাণ অতি নগণ্য।
তথ্য বলছে, জুন শেষে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র দুই কোটি ৫৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ খেলাপি থেকে আদায়ের হার শূন্য দশমিক চার শতাংশ। একই অবস্থা বেসিক ব্যাংকেরও। ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল আট হাজার ৮১ কোটি টাকা, জুন পর্যন্ত খেলাপি হওয়া ঋণ থেকে ব্যাংকটি আদায় করতে পেরেছে মাত্র ১২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ শূন্য দশমিক দুই শতাংশ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে ব্যাংকটি। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকেরও একই অবস্থা। খেলাপি হয়ে পড়া ১৩ হাজার ৭৭১ কোটি টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ২২ কোটি। আদায়ের হার শূন্য দশমিক দুই শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী, রূপালি ও সোনালী ব্যাংকও এক শতাংশের ঘর অতিক্রম করতে পারেনি। সব মিলিয়ে খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সমন্বিত আদায় হার শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ।
অন্যদিকে খেলাপি গ্রাহক থেকে এক শতাংশের নিচে আদায় করা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে এবি ব্যাংকের শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক আদায় করেছে শূন্য দশমিক ৫, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক শূন্য দশমিক ১, আইএফআইসি ব্যাংক শূন্য দশমিক ৪, মিডল্যান্ড ব্যাংক শূন্য দশমিক ৯, মধুমতি ব্যাংক শূন্য দশমিক ৩, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক শূন্য দশমিক ৭, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক শূন্য দশমিক ৮, ওয়ান ব্যাংক শূন্য দশমিক ৪, পদ্মা ব্যাংক শূন্য দশমিক ৩, প্রিমিয়ার ব্যাংক শূন্য দশমিক ৬, সাউথইস্ট ব্যাংক শূন্য দশমিক ৮ এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। খেলাপি গ্রাহকদের থেকে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক।
বাংলাদেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যেও খেলাপি ঋণ থেকে আদায়ের অবস্থা একই রকম। আলোচ্য সময়ে খেলাপিদের থেকে মাত্র তিন লাখ টাকা আদায় করতে পেরেছে ব্যাংক আল-ফালাহ্, হিসাব অনুযায়ী যাদের আদায়ের হার শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া হাবিব ব্যাংকের আদায়ের হার শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বেশিরভাগ মানুষ হাতে টাকা রেখে দিতে চাচ্ছেন, কারণ প্রয়োজনীয় চলতি মূলধনের টাকায় কিস্তি দিলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। তাই সবাই ঋণ পরিশোধে বিমুখ ছিলেন। তাছাড়া করোনার প্রভাব ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকায় ঋণ পরিশোধের বড় সুবিধা পাওয়ার একটা গুঞ্জন চলছিল। সেই সুবিধা পেতে ইচ্ছাকৃতভাবেই তখন তারা ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করেননি।