দ্বন্দ্ব-সংঘাত নয়, দেশে দেশে শান্তি বিরাজ করু

মো. জিল্লুর রহমান:‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ স্লোগানে একটি যুদ্ধবিহীন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৮১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত নম্বর ৩৬/৬৭ প্রস্তাব অনুসারে প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার দিনটিকে আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তীকালে ২০০১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত ৫৫/২৮২ নম্বর প্রস্তাব অনুসারে ২০০২ সাল থেকে প্রতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস হিসেবে উদ্যাপনের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিশ্ব শান্তি দিবস বা আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস জাতিসংঘ কর্তৃক প্রস্তাবিত একটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত দিন, যা এর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত বিশ্বের সব দেশ ও সংগঠন কর্তৃক যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। পৃথিবী থেকে যুদ্ধ, হিংসা ও আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগের মতো ঘটনা মুছে ফেলতেই প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ১৯৮২ সালে প্রথমবার আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালন করেছিল।

১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর তৎকালীন বিশ্ব রাষ্ট্রশক্তিদের দ্বারা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলে সারা বিশ্বের মানুষ এটাকে সমর্থন দিয়েছিল। সবার প্রত্যাশা ছিল একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। হানাহানি, যুদ্ধ ও ধ্বংস শেষ করে এবার বিশ্বে শান্তি বিরাজ করবে। সারা বিশ্বে এবার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের যে দেশগুলো ছিল, তাদের ওপর সবার প্রত্যাশা ছিল বেশি। তারা পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবে এবং পাশাপাশি অন্য ক্ষুদ্র বা অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোকেও সহায়তা করবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। জাতিসংঘ তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পালনে অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। প্রথমত, জাতিসংঘ উপনিবেশবাদের সমাপ্তি ষোঘণা করতে পেরেছে। রাষ্ট্রগুলোকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব দান করতে জাতিসংঘের ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল। ষাটের দশকে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের জাতীয়তাবাদের মুক্তিসংগ্রামকে জাতিসংঘ সহায়তা করেছে। যেসব জনগোষ্ঠী নিজেদের ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে, সেগুলোকে জাতিসংঘ নির্বিঘেœ সহায়তা করেছে। ফলে উপনিবেশবাদ থেকে বিশ্ব মুক্ত হয়েছে। অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রের জš§ হয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের এই উদ্যোগ অনেক বেশি ইতিবাচক ও সর্বজনীন।

জাতিসংঘ কর্তৃক শান্তি রক্ষা মিশন জাতিসংঘের আর একটি সফলতা। শান্তি রক্ষা মিশনের মাধ্যমে জাতিসংঘ যুদ্ধে আক্রান্ত দেশগুলোকে সহায়তা করছে, বিভিন্ন আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বিদ্রোহ দমনে সেই রাষ্ট্রগুলোকে শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা সহায়তা করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ শান্তি রক্ষায় সর্বদা উদ্যোগী, সব অবস্থায় শান্তির পক্ষে ও শান্তি রক্ষাকে বাংলাদেশ মৌলিক কাজ বলে মনে করে। জাতিসংঘের এই মিশনে বাংলাদেশের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বাংলাদেশ সুষ্ঠুভাবে পালন করছে। অন্যদিকে বলা যায়, জাতিসংঘও শান্তি রক্ষা মিশনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব শান্তি রক্ষা, যা তার মৌলিক কাজ তা পালন করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষা দিবসে এ কথাগুলো বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। তবে এটাও বলে রাখা দরকার, এই কার্যক্রম সবসময় নির্বিঘœ থাকেনি। অনেক সময়ই এ কাজ নিয়ে প্রশ্ন এসেছে। তারা সবাই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, এটা জাতিসংঘের একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। যদিও এখনও শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রম চলমান, আমরা চাই আস্তে আস্তে এই কার্যক্রম কমে আসুক। সারা বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। যদিও এখন পর্যন্ত এই বাহিনী রাখার যৌক্তিকতা আছে।

বর্তমান বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। হিরোশিমা-নাগাসাকি পৃথিবীর মানুষের কাছে নৃশংসতম বর্বরতার একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে বছরের পর বছর ধরে চিত্রিত হয়ে আসছে। হিরোশিমা-নাগাসাকির নাম শুনলেই ভয়ে আতঙ্কিত ওঠে শান্তিপ্রিয় মানুষের মন। এর চির অবসান হওয়া দরকার। এজন্য প্রয়োজন সব দেশের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি। কেউ পারমাণবিক অস্ত্রের বিশাল মজুত গড়ে তুলবে, পৃথিবীকে তটস্ত রাখবে, আর কেউ এর অধিকারীও হতো পারবে না, তা তো কোনো আইন হতে পারে না। এজন্য বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিধর দেশগুলোর সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব পরিহার করতে হবে।

পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার ও সুবিধা থেকে এসব মানুষ বঞ্চিত। অথচ মানবজাতিকে ধ্বংসের জন্য উন্নত দেশগুলো মারণাস্ত্র তৈরির পেছনে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। এসব না করে উন্নত দেশের নেতারা আজ যদি তাদের সময়, শ্রম ও অর্থকে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান দারিদ্র্য, অশিক্ষা, মারণব্যাধি এইডস এবং কভিড মহামারি নির্মূলের জন্য ব্যয় করত, তাহলেই বরং বিশ্ববাসী উপকৃত হতো এবং শান্তি পেতো। মরণাস্ত্র তৈরির জন্য যে বাজেট ব্যয় হচ্ছে, সে-ই বাজেটের সিকি ভাগও যদি আজ মানবজাতির জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হতো তাহলে পৃথিবী আজ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতো। আর এটাই হতো সত্যিকার অর্থে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র চর্চা।

তবে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রগুলোর যে চরিত্র ছিল এখন বাস্তবতই তা অনেকটা পাল্টে গেছে। আগে রাষ্ট্রীয় সংঘাতের চেহারা ছিল আন্তঃরাষ্ট্রীয়, এখন এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের সংঘাত। বর্তমানে এমন সংঘাতের চেহারা পাল্টে গেছে বা বলা চলে নতুন রূপ পেয়েছে। বিশেষ করে পরিবর্তিত বিশ্ব এই প্রেক্ষাপট তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৯১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাতের চেয়ে বড় বিপদের কারণ হয়েছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংঘাত। বাইরের রাষ্ট্র এসে আক্রমণ করছে না, কিন্তু রাষ্ট্রের নিজের ভেতরেই যে সংঘাত ও দ্বন্দ্ব, তা-ই তাকে সামগ্রিকভাবে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলোর অবস্থা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে। যেমন কঙ্গো, সিয়েরা লিওন, আইভরি কোস্ট ও সুদান ছাড়াও আরও কিছু নতুন দেশ, যেমন ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানের ঘটনা। বর্তমানে সব দেশই অন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাতে ভুগছে। ফলে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাতের চেয়ে এখন অন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাত তীব্র হচ্ছে। রূপান্তর ঘটেছে, বদলে যাচ্ছে সংঘাত ও সংগ্রামের চিত্র। খুবই দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সংঘাতের এই চেহারা দিন দিন বেশ জটিল হচ্ছে। যদিও জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশে শান্তি রক্ষা মিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, তাই অন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাত সুরাহা করার জন্যও প্রস্তুত। কিন্তু তাতে খুব বিশেষ সফলতা দৃশ্যমান হচ্ছে না। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় কয়েক বছর ধরে যে ধরনের সংঘাত বিরাজ করছে, তা আমাদের মনে শঙ্কার জš§ দেয়। আবার কয়েক বছর ধরে যেমন উদ্বাস্তু স্রোত দেখা যাচ্ছে, তাতে সমস্যা আরও প্রকট বলেই বোধ হয়। হাজার হাজার মানুষ যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে, জীবন বাঁচানোর জন্য অন্য দেশের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে, তা খুবই পীড়াদায়ক। এগুলো আমাদের মর্মাহত করে, হতাশ করে।

মনে রাখা দরকার, ব্যাপক এই জনস্রোত ও লাখ লাখ জনগোষ্ঠীর উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার চলমান সংঘাতের ফসল। এটা কিন্তু সংঘাতের কারণ নয়, ফলাফল। তাই যে অবস্থা এই সংঘাতের কারণ, তা নিবারণ করা অতি জরুরি। এই সংঘাতে যাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তাদেরই তা নিবারণ করতে হবে। তারা হয়তো বলবে, এ সমস্যা ওইসব দেশের নিজেদের সমস্যা। কিন্তু এটা যদিও অনেকের ব্যক্তিগত মত, তবুও তাদের অবশ্যই এই সংঘাত নিবারণের জন্য নিজেদের সচেষ্ট হতে হবে। তারা নিজেরা না পারলে জাতিসংঘ এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু জাতিসংঘ অনেক ক্ষেত্রে সফল হতে পারছে না।

যুদ্ধ কোনো দেশ বা জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। মানুষ যেমন একা বসবাস করতে পারে না, ঠিক তেমনি একটি দেশও কখনও একা চলতে পারে না। বলা যায়, এই বিশ্বটা একটা সংসার, প্রতিটি দেশ তার সদস্য। পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি বজায় রেখে সবাই দেশ পরিচালনা করবে, এটাই সবার কাম্য। কিন্তু প্রায়ই প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সে পরিসংখ্যানে যেন হিসাব মিলছে না। ঠুনকো বিষয় নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে কখনও মৃদু, আবার কখনও উত্তাল হাওয়ার মতো তর্ক-বিতর্ক ও যুদ্ধ লেগেই আছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের স্মৃতি খুব বেশি সুখকর নয়। ১৯৪৭, ১৯৫৬ ও ১৯৯৯ সালের তিনটি যুদ্ধ উভয় দেশের জন্য অস্বস্তিকর ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ তৈরি করেছিল। দেশ দুটি পরমাণু শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার ফলে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। দুই দেশের মুরব্বিস্থানীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া কিংবা চীন, তারাও এরকম যুদ্ধ চায় না। সুতরাং আমাদেরও প্রত্যাশাÑ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই।’

তবে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, যখন আমরা বিশ্ব শান্তি দিবস পালন করছি, তখন আসলেই কি বিশ্বে শান্তি বিরাজ করছে? মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করে এ এলাকায় একটি অশান্ত পরিবেশ তৈরি করছে। লাখ লাখ নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া কোনোক্রমেই বিশ্ব শান্তির সহায়ক নয়। এভাবে সারা বিশ্বে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা থেকে এই প্রশ্ন আসতেই পারে। এখন অনেক দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে, মানুষ জীবিকার তাগিদে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষ এখন নিজ দেশে নিরাপদ বোধ করছে না। নিজ দেশে পরাধীন। সর্বত্রই একটা অস্থিরতা বিরাজমান। সুতরাং সংঘাত নয়, যুদ্ধ নয়, অশান্তি নয়, দেশে দেশে শান্তি বিরাজ করুক তা-ই হোক বিশ্ব শান্তি দিবসের সর্বজনীন স্লোগান।

ব্যাংক কর্মকর্তা

Inclusive accommodation