নিজস্ব প্রতিবেদক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যানসার গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সাইক্লোট্রন সুবিধাদিসহ সর্বাধুনিক পেট-সিটি (পজিট্রন ইমিশন টোমোগ্রাফি) প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে। এ পরীক্ষাটির মাধ্যমে ক্যানসার লেভেল দ্রুত শনাক্ত করা যায়। এটি দেশে ক্যানসার চিকিৎসাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
গতকাল রোববার বেলা ১১টায় বিএসএমএমইউয়ের এফ ব্লকের অনকোলজি বিভাগে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের অধীনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসের (নিনমাস) আওতায় এটি স্থাপন করা হয়েছে।
পেট-সিটি বিভাগের পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শামীম মমতাজ ফেরদৌসী বেগম জানান, এখন কম খরচে ক্যানসার লেবেল শনাক্ত করা যাবে। বেসরকারি হাসপাতালে পেট সিটি স্ক্যান করাতে ৬০-৬৫ হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। আর বিএসএমএমইউতে আমরা মাত্র ২৫ হাজার টাকায় পেট সিটি স্ক্যান করাতে পারব। পেট সিটি করাতে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে এন্ট্রি করাতে হয়। আর পরীক্ষা (টেস্ট) সকাল ৯টায় শুরু হয়ে শেষ হয় বিকাল ৪টায়।
প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিএসএমএমইউতে দুটি পেট-সিটি মেশিন এবং রেডিওকেমিস্ট্রিসহ একটি সাইক্লোট্রন মেশিন স্থাপন ও ঢামেকে একটি পেট- সিটি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এই সাইক্লোট্রন সুবিধাদিসহ পেট-সিটি দ্রুত ক্যানসার শনাক্তে দেশের ক্যানসার চিকিৎসায় যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছে। সাইক্লোট্রন বিজ্ঞানে একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার যেখানে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে মানবচিকিৎসা ও গবেষণার জন্য তেজস্ক্রিয় পদার্থ তৈরি করা হয়।
তিনি বলেন, ‘শরীরে যেসব স্থানের কোষগুলো বেশি সক্রিয় থাকে, পেট সিটি স্ক্যান কেবল সেসব স্থানের চিত্র বা তথ্য প্রদান করে থাকে। অপরদিকে সিটি স্ক্যান কোনো স্থানের গঠনগত এবং অবস্থানগত তথ্য বা চিত্র সূক্ষ্মভাবে প্রদান করে। এই দুটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে গঠিত স্ক্যানারে একটি ফিউশন ইমেজ একই সময়ে পাওয়া যায়।’
নুরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এই দুটো ইমেজের সমন্বিত ইমেজটি একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসককে শরীরের যেসব স্থানের কোষগুলো বেশি সক্রিয়, অর্থাৎ ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলো খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। এ পরীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া তথ্য বা চিত্র চিকিৎসককে কোনো বেদনাদায়ক পরীক্ষা এবং সার্জারি ছাড়াই রোগ নির্ণয় করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে সাহায্য করে। একটি নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসার ফল পর্যবেক্ষণ করতেও এই পরীক্ষাটি করা হয়।’
চিকিৎসকরা বলেন, পেট সিটি অন্যান্য ইমেজিং টেকনোলজি, যেমন এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, আলট্রাসনোগ্রাম, এমআরআই প্রভৃতি প্রযুক্তি থেকে ভিন্ন মাত্রার। কারণ এগুলো শুধু শরীরে টিউমারের আকার, আকৃতি ও অবস্থান সম্পর্কে ধারণা দেয়। কিন্তু পেট সিটি ক্যানসার (ম্যালিগন্যান্ট টিউমার) বা ক্যানসার নয় (বিনাইন টিউমার), দুটো সম্পর্কেই ধারণা দিতে সক্ষম।
পজিট্রন ইমিশন টোমোগ্রাফি টিউমার বা শরীরে অ্যানাটমিকাল অ্যাবনরমালিটি বা ক্যানসার আক্রান্ত স্থান শনাক্ত করতে পারে। সেইসঙ্গে পারে শরীরের প্রতিটি কোষের অ্যাবনরমাল মেটাবলিক এবং বায়োকেমিকেল অ্যাকটিভিটি শনাক্ত করতে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কন্যার সহযোগিতায় আমরা অত্যন্ত অত্যাধুনিক একটি চিকিৎসাযন্ত্র সাইক্লোট্রন ও পেট-সিটি স্থাপন করতে পেরেছি, যার মাধ্যমে দেশে সর্বপ্রথম পেট-সিটি প্রযুক্তি স্থাপনে এক ধাপ এগিয়ে গেল সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাত। এটি দেশের উন্নয়নের একটি বড় উদ্ভাবক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিতে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। সাইক্লোট্রন সুবিধাদিসহ পেট-সিটি, বাংলাদেশের ক্যানসার চিকিৎসায় যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছে।’
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তো একসঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। এখন কীভাবে এক ভাই আরেক ভাইয়ের ওপর হামলা করি। মানসিক চিকিৎসা ছাড়া এ জাতির রক্ষা নেই। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমরা সবাই মানুষ হই। মানুষের সেবা করি।’
তিনি বলেন, ‘পেশা আর ব্যবসা এক নয়। সবাই যদি খারাপ থাকে, আমি কীভাবে ভালো থাকি। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। আমরা ট্রেড ইউনিয়নের মতো করে কথা বলছি।’
এসময় তিনি নিজের রচিত একটি কবিতার লাইন আবৃত্তি করেন, ‘টাকা-বাড়ির টানটা প্রবল, গতি তার রকেট; কিন্তু আমরা ভুলে যাই, কাফনের নাই পকেট।’
বিএসএমএমইউ উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘গত এক দশকে আমাদের দেশের রোগীরা বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার জন্য কম গিয়েছে। আমরা আশা করছি, দশ বছর পরে আমাদের দেশে বাইরে থেকে চিকিৎসা নিতে আসবে। যার সূচনা হলো এ সাইক্লোট্রন ও পেট-সিটি স্থাপন। আমরা এটিও চাই, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিটি জেলায় যাতে এই যন্ত্র স্থাপন করা হয়।’
সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সানোয়ার হোসেন। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সদস্য (জীববিজ্ঞান) অধ্যাপক ডা. অশোক কুমার পাল।