শেখ আবু তালেব: ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থের সরবরাহ বাড়ায় এসএলআর (ব্যাংকগুলোর আমানতের বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দৈনিক জমাকৃত অর্থ) হার এক শতাংশ কমিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি দেয়া হয়েছে এডিআর কমানোসহ একাধিক সুবিধা। কিন্তু তারপরও আন্তঃব্যাংক কলমানিতে সুদহার ও ধারের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে তা সর্বোচ্চ শতকরা পাঁচ টাকা ২৫ পয়সায় উঠেছে, বছর দেড়েক আগেও যা ছিল এক শতাংশের নিচে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন অনেক ব্যাংকেরই নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। এজন্য আমানত বেশি থাকা ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এতে উচ্চ আমানত থাকা ব্যাংকগুলো কলমানিতে অর্থ ধার দিয়ে সুদ আয় বাড়িয়ে চলছে।
প্রসঙ্গত, কলমানি মার্কেট হচ্ছে আন্তঃব্যাংক অর্থ ধার নেয়ার বাজার। এক থেকে সাত দিন মেয়াদে স্বল্প সময়ের জন্য এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংক যে অর্থ ধার করে থাকে। এটিকে কলমানি বলে। ব্যাংকগুলো সাধারণত হঠাৎ চাহিদা বা বড় অঙ্কের আমানত চলে গেলে কিছু সময়ের জন্য নগদ অর্থের সংকটে পড়ে। এই সময়ে অপেক্ষাকৃত কম আমানত থাকা ব্যাংকগুলো দ্রুত কলমানি থেকে অর্থ নিয়ে গ্রাহক চাহিদা মিটিয়ে থাকে।
দেশের ব্যাংক খাতে করোনা মহামারির প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই কলমানিতে সুদহার এক টাকার নিচে ছিল। এ সময়ে নগদ অর্থের চাহিদা খুব একটা ছিল না। কিন্তু এখন ঋণ চাহিদা বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু সেই হারে বাড়েনি আমানত প্রবৃদ্ধি। ফলে মাঝারি মানের ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থের চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই সুযোগে ব্যাংকগুলো ধারের বিপরীতে সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে।
কলমানি সুদহার বৃদ্ধির বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকে দৈনিক নগদ জমার (সিআরআর) জমা দিতে হচ্ছে। আমানত বাড়লে, জমার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ঋণ বাড়ছে, এজন্য নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে কিছু ব্যাংকের। এজন্য কলমানিতে ধার বাড়ছে। কিন্তু এটি সাময়িক না দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারিতেও কলমানি মার্কেটে গড় সুদহার ছিল এক টাকা ৭৮ টাকা। এর পরই তা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে, গত মে মাসে যা পৌঁছে দুই টাকা ৮০ পয়সায়। আবার গত আগস্টে দুই টাকার নিচে নেমে যায়। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর থেকে আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সর্বশেষ কলমানি সুদহার পাঁচ টাকার ওপরে চলে যায় গত ২৪ নভেম্বর। দিনটিতে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল পাঁচ টাকা ২৫ পয়সা। এই সময়ে সর্বনি¤œ সুদহার ছিল এক টাকা। গড় সুদহার ছিল চার টাকা। টাকার অঙ্কে লেনদেন হয় পাঁচ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ ধার করেছে ব্যাংকগুলো তাদের সহযোগী ব্যাংক থেকে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কলমানি বাাজারের সুদহার চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে। করোনাকালে অনেক ব্যাংকই অতিরিক্ত তারল্য সরকারকে বিভিন্ন বন্ড ও বিলের বিপরীতে ধার দিয়েছে। কিন্তু এখন নগদ অর্থের প্রয়োজনে আবার ধার শুরু করেছে। মূলত প্রভিশন (ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে অর্থ জমা রাখার বাধ্যবাধকতাকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বলে) ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর চাহিদা বেশি থাকে। কিন্তু এখন মাঝারি আকারের ব্যাংকগুলোর চাহিদাও বাড়ছে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো তাদের মূলধনের বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট হারে সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারে। এর চেয়ে বেশি পারে না। কিন্তু কয়েকটি ব্যাংকের সরকারকে ধার দেয়া বা ট্রেজারিতে বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমায় রয়েছে। আবার তারা ঋণ দিচ্ছে না সেভাবে। এতে হাতে থাকা আমানত কলমানিতে খাটাচ্ছে। কিন্তু চাহিদা বেশি থাকায় সুদহার বেড়েছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি মিলিয়ে ব্যাংক খাতের ১০টি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে। এদিকে তারল্য সংকটে ভুগছে ১৫ ব্যাংক। মূলত এসব ব্যাংকের চাহিদাই বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জানুয়ারি কলমানিতে সর্বোচ্চ সুদহার উঠেছিল ৯ টাকায়।