রবিউল আউয়াল রবি, ময়মনসিংহ: পিঠাপুলির দেশ বাংলাদেশ। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে পিঠাপুলি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। ভাতের পরে একচেটিয়া বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি অভ্যস্ত রয়েছে পিঠাপুলিতে। প্রায় ১৫০ প্রকারের পিঠা রয়েছে বাংলাদেশে। তন্মধ্যে প্রচলিত ৩০ প্রকারের পিঠা হচ্ছে চিতই, ভাপা, ফুয়া, পাটিসাপটা, রসের পিঠা প্রভৃতি। এর মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে ভাপা ও চিতই পিঠা। আর সেই চিতই পিঠার সাথে যদি থাকে রকমারি পদের ভর্তা, তাহলে তো আর কথায় নেই।
একসময় মূলত গ্রাম প্রধান এলাকায় এই পিঠা তৈরী করা হলেও, সময়ের সাথে সাথে সেটি পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর শুধু গ্রামে নয়, শহরে বসেই নেয়া যায় সে পিঠার স্বাদ। আর ব্যস্ততম এ শহরের মানুষদের গ্রামীন সেই মুখরোচক পিঠার স্বাদ দিতে পিঠা কারিগরদের জুড়ি মেলা ভার। শহুরে মানুষদের পিঠার স্বাদ দেয়ার পাশাপাশি আয়ের পথও বেছে নিয়েছেন তারা।
পিঠা তৈরী করছেন হাফিজুল। ছবি: শেয়ার বিজ
তেমনই এক পিঠা কাড়িগর মো. হাফিজুল ইসলাম। মণ্ডা ও ছিপের জন্য বিখ্যাত ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার মুজাটি ফার্মের মোড়ের পিঠা দোকানি সে। এক সময় জীবিকা নিয়ে হতাশায় থাকা হাফিজুল এখন দৈনিক পিঠা বিক্রি করেন সাত থেকে আট হাজার টাকার। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার পিঠাকে কেন্দ্র করে মুজাটি ফার্মের ওই মোড়ে জমে উঠে আড্ডা। দূর-দূরান্ত থেকে তার পিঠা খেতে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। অনেকে আবার নিজে খাওয়ার পাশাপাশি পার্সেল নিয়ে যান পরিবারের জন্য।
গত চার বছর যাবৎ শীতকালে চিতই পিঠার সাথে ২৩ থেকে ৩০ পদের রকমারি সব ভর্তার স্বাদ পূরণ করে আসছেন হাফিজুল। যে কারণে রাত হলেই ভিড় জমে হাফিজুলের পিঠার দোকানে। পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড মোজাটি গ্রামের বাসিন্দা মোঃ ইউনুস আলীর ছেলে তিনি।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হাফিজুলের পিঠার আড্ডায় গিয়ে দেখা যায়, টেবিলের উপর সারি ধরে শুধু ভর্তার বাটি। পাশে জ্বলছে মোট ৫টি মাটির চুলা। আর সেই চুলায় চিতই ভাজতে হাফিজুলের হাতের কোনো বিরাম নেই। এরই ফাঁকেই তিনি কাস্টমারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন, নিচ্ছে পিঠার অর্ডার। হাসিমুখে প্রত্যেকের কথা শুনছেন। পিঠার সাথে হাফিজুলের ব্যবহারেও মুগ্ধ হন সবাই। আর এই কারনে অন্য পিঠা কারিগরদের থেকে হাফিজুলের ক্রেতাও থাকে বেশি।
ক্রেতাদের পিঠার সাথে ভর্তা পরিবেশন করছেন হাফিজুল। ছবি- শেয়ার বিজ
হাফিজুলের সাথে কথা বলে জানা যায়, ময়মনসিংহ, মুক্তাগাছা, জামালপুর ও টাঙ্গাইল সহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভোজনরসিকরা প্রতিদিনই বন্ধু-বান্ধব এমন কি দল বেধে চিতই পিঠা ও হরেক রকমের ভর্তার স্বাদ গ্রহণ করতে ছুটে আসেন তার পিঠার দোকানে। শুধু কি তাই, অনেক গুণী মানুষের দেখাও মিলবে এখানে। স্থানীয় অনেক কবি-সাহিত্যিকদের সন্ধ্যার আড্ডাস্থলও হাফিজুলের পিঠাঘর।
হাফিজুলের পিঠার দোকানের মূল আর্কষণ হলো পিঠার সাথে ২৩ পদের ভর্তার পরিবেশনা। যেখান থেকে নিজের পছন্দের সব ধরনের ভর্তার আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়।
আলু, কলা, সরিষা ও কালিজিরা ভর্তা ছাড়াও রয়েছে কচুপাতা, বেগুন, কাঁচামরিচ, লালশাক, হেচে শাক, পালং শাক, বার্তা শাক, চ্যাপা শুটকি, চিংড়ি শুটকি, পুঁটি শুটকি, কাচকি শুটকি, মলা শুটকি, নোনা ইলিশ, টাকি মাছ, বাদাম, তিশী, তিল, টমেটো সস, ডাউল ভর্তাসহ নানা ধরনের ভর্তার সমাহার। সাথে ডিমপিঠা ও মাংস পিঠা তো আছেই।
চলছে পিঠা তৈরী। ছবি-শেয়ার বিজ
নবম শ্রেণীর ছাত্র ভাতিজা কামরুল হাসান শুভকে সাথে নিয়ে প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে পিঠা বানানো শুরু করেন হাফিজুল ইসলাম, যা চলে রাত ১০-১১ টা পর্যন্ত পর্যন্ত। আর সকালে বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানরা পিঠার চাল গুড়ো করা, ভর্তা বানানোর কাজগুলোতে সাহায্য করেন। পিঠা বানাতে বানাতে হাফিজুল ক্লান্ত হয়ে গেলে হাল ধরের ভাতিজা কামরুল। অল্প বয়সেই হাফিজুলের মতোই দক্ষ পিঠা কারিগর হয়ে গেছে সে।
প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০ পিস পিঠা বিক্রি করেন তিনি। যার প্রতিটি পিঠার মূল্য ধরেন মাত্র পাঁচ টাকা। সাথে থাকে ২৩ পদের ভর্তা যা সম্পূর্ণ ফ্রি। ভর্তা দিয়ে চিতই ছাড়াও ১৫ টাকায় ডিম চিতই আর মাংশ পিঠা রয়েছে সেখানে। সেগুলোর দাম আবার ভিন্ন।
চিতই পিঠায় নিজের জীবন বদলে যাওয়া সম্পর্কে শেয়ার বিজকে হাফিজুল বলেন, ‘যৌবনে ভাগ্য বদলে বিদেশে গিয়েছিলাম। তাও আবার দু-একটি দেশ নয়, দুবাই, ইরাক, তুরস্ক ও কুয়েতে ঘুড়েছি ভাগ্য বদলের আশায়। কিন্তু তাতেও জীবনে আর্থিক সুখ খুঁজে পাইনি। অগত্যা ফিরে আসি নিজ দেশে, নিজ গ্রামে। কিন্তু ততদিনে পুঁজিপাটা যা ছিল তাও প্রায় শেষ। কী করবো, কীভাবে চলবো—এসব ভাবতে ভাবতেই দিলাম চায়ের স্টল। ছেলের নামে নাম রেখেছিলাম মুন্না টি-স্টল। এতেও ঠিক সুবিধা হচ্ছিল না। সামলাতে পারছিলাম না সংসারের খরচ। পরে বছর চারেক আগে অনেক ভেবে এই পিঠা বিক্রি শুরু করেছি। আগে শুধু শীতকালে ব্যবস্থা হলেও. এখন সারা বছরই ভালোই ব্যবসা হয়।’
হাফিজুলের দোকানের নানা পদের ভর্তা। ছবি: শেয়ার বিজ
পিঠা ও ভর্তা বিক্রি প্রসঙ্গে হাফিজুর বলেন, ‘প্রথমে দুই পদের ভর্তার সাথে চিতই পিঠা বানানো শুরু করি। মানুষের ব্যাপক সাড়া পেয়ে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। দূর-দূরান্তের মানুষের পিঠার সাথে ভর্তার চাহিদা বিবেচনায় আজ পর্যন্ত প্রায় ৩০ পদের ভর্তা আমি পিঠার সাথে পরিবেশন করেছি। ভর্তা খেয়ে যখন মানুষ আমার প্রশংসা করে তখন খুবই ভালো লাগে।’
উপজেলার কুমারগাতা ইউনিয়ন হাফিজুলের পিঠা খেতে থেকে আসা মনিরুজ্জামান আকাশ নামের এক যুবক বলেন, প্রতিবছর শীতের সময় প্রায় দিনই আমি বন্ধুদের নিয়ে এখানে পিঠা ও ভর্তা খেতে আসি। দেশের অনেক জায়গাতে ঘুরেফিরে কোথাও এত পদের ভর্তা আমি দেখেনি। শুধু তাই নয় এখানকার ভর্তার স্বাদ সত্যিই অসাধারণ।
ময়মনসিংহ থেকে আসা একাধিক ভোজনরসিক বলেন, বন্ধুর ফেসবুকের ভিডিও দেখে ২৩ পদের ভর্তার স্বাদ গ্রহণ করতে এখানে পিঠা খেতে এসেছি। বিভিন্ন এলাকার লোকজনের মেলবন্ধনে ভালোই লাগছে।