শিশু আনন্দভুবন: প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ

মো. শিপলু জামান: মোরশেদ সাহেব প্রতিজ্ঞা করেছেন আর ধূমপান করবেন না, প্রতিদিন যে পরিমাণ টাকা ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিতেন, তা তিনি ভালো কাজে ব্যবহার করার জন্য চিন্তা করছেন। একদিন রাস্তায় হাঁটার সময় অসুস্থ-অসহায় এক শিশুকে দেখে তার খুব কষ্ট হলো। মায়া করে তিনি শিশুটিকে কিছু খাবার, জামা আর খেলনা কিনে দিলেন। আর তাতে শিশুর মুখে হাসি ফুটে উঠল, চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো হাসি। শিশুটির হাসি দেখে মোরশেদ সাহেব যে সন্তুষ্টি ও তৃপ্তি লাভ করলেন, তা ভাষায় বর্ণনার অতীত। এর পর থেকে তিনি প্রায়ই রাস্তায় ও হাসপাতালে শিশুদের ওয়ার্ডে ফল, চকলেট, খেলনা, রংপেন্সিল প্রভৃতি বিতরণ করেন। তাতে তিনি অনেক মানসিক ও আত্মিক শান্তি পান। মোরশেদ সাহেবকে দেখে তার অন্য অনেক বন্ধুও এ কাজে যুক্ত হয়েছেন।

কাল্পনিক হলেও গল্পটা সত্য, এখানে অনেক কিছু শেখার আছে। গল্পটা মানবতার, গল্পটা শিশুদের জন্য এগিয়ে আসার। চার বছরের চঞ্চল ও প্রাণোচ্ছল আবদুর রহমান ক্রিকেট খেলতে খুবই পছন্দ করত। রহমান ছিল শিক্ষক বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান, সবার চোখের মণি। লেখায় অতীতকালের ব্যবহারই বুঝিয়ে দেয় ছোট রহমান এই পৃথিবীতে আর নেই। আবদুর রহমানের জন্ম হয়েছিল ২০১৫ সালে। দুই বছর ৯ মাস বয়সে আবদুর রহমানের ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে। চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় এটি Medulloblastoma বা ক্যানসার। দেশে-বিদেশে চিকিৎসার সর্বাত্মক প্রায়াস চলে, কিন্তু পৃথিবীতে আবদুর রহমানের সময় অতিদ্রুত শেষ হয়ে যায়। ২০১৯ সালে চার বছর দুই দিন বয়সে আবদুর রহমান সবাইকে ছেড়ে চলে যায়। সেই আবদুর রহমানের ইচ্ছা পূরণ করতেই আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তার বাবা-মা, যার মাধ্যমে পৃথিবীতে অন্যের মধ্যে যুগে যুগে বেঁচে থাকবে আবদুর রহমান।

আবদুর রহমানের চিকিৎসা চলার সময়ে তার বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, শিশুদের চিকিৎসাপদ্ধতি শুধু ওষুধনির্ভর নয়। শিশুরাই সবচেয়ে ভালো পর্যবেক্ষক। তাদের সঙ্গে আগে সুসম্পর্ক তৈরি করতে হয়। শিশু বলে অবহেলা বা অবমূল্যায়ন করার কোনো সুযোগ নেই তাদের বেলায়। চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের পরিবেশ, চিকিৎসকের ব্যবহার ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিশুদের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য। অন্য সব শিশুর মতোই আবদুর রহমানও প্রতিদিনের বিষয়গুলো খেয়াল করত।

বিদেশের হাসপাতালে আবদুর রহমান তার প্রিয় ডাক্তার ও নার্সকে খুঁজত। ডাক্তার বা নার্স আবদুর রহমানকে চকলেট, রংপেন্সিল বা ছোট্ট কোনো উপহার দিতেন। আবদুর রহমান উপহার পাওয়ার পর আবার ডাক্তার-নার্সকেও তার ভালোবাসার উপহার দিত। নিতে না চাইলে আবদুর রহমান খুব বিব্রত হতো। ছোট্ট উপহার, কিন্তু এর তাৎপর্য ছিল অপরিসীম। চিকিৎসা শুধু ওষুধে নয়; ভালোবাসা, আদর, মায়া-মমতা ও ভালো ব্যবহারেও হয়। এই সত্যটা আরেকবার অনুধাবন করিয়ে গেছে আবদুর রহমান। দেশের প্রচলিত ব্যবস্থায় হাসপাতালগুলোয় অসুস্থ শিশুদের জন্য ওষুধনির্ভর চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিকভাবে সুস্থ রাখার তেমন কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই। শিশুদের চিকিৎসা পদ্ধতির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা, যা তাদের মনে আস্থা সৃষ্টি করতে পারে। শিশুদের কথা শুনতে হবে, তাদের অবহেলা করা যাবে না। তাদের ধন্যবাদ দিতে এবং ধন্যবাদ বলতে শেখাতে হবে।

একজন সন্তানহারা বাবার সেই অনুধাবন বাংলাদেশের প্রতিটি হাসপাতালে শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির এক বিরাট প্রচেষ্টা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করেছে। দেশের সব হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাকে শিশুবান্ধব করার একটি নতুন ধারণা নিয়ে রহমানের সাহসী বাবা একাই ‘শিশুর জন্য আবদুর রহমানের ভালোবাসা: শিশু আনন্দভুবন’ নামে একটি কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। এর আওতায় শিশু আবদুর রহমানের বাবা-মা তাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সন্তানের ছোট্ট স্বপ্ন দেশের প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ঈযরষফৎবহ’ং চষধু ঈড়ৎহবৎ বা শিশু আনন্দভুবন বাস্তবায়নে নিজেদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তারা হাসপালগুলোয় শিশু রোগীদের খেলার জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান রাখার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছেন এবং সেখানে বিভিন্ন বয়সী শিশুর জন্য খেলনা, বইপত্র ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার এবং মানসম্মত চকলেট সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন।

কার্যক্রমটি একদিকে যেমন হাসপাতালে কর্মরত সবাইকে উন্নত অনুশীলন প্রদর্শনে অনুপ্রাণিত করবে, অন্যদিকে আবদুর রহমানের সন্তানহারা বাবার মতো অন্যদের শোককেও নতুন শক্তিতে পরিণত করে সব শিশুর জন্য একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টিতে আগ্রহী করে তুলতে সাহায্য করবে। ভালো কাজে নাগরিকদের অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি এবং হাসপাতালসহ অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানে শিশুদের জন্য নিরাপদ ও আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টিতে নতুনত্বের উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে কার্যক্রমটি ভূমিকা রাখতে পারে।

সমাজের প্রত্যেক বিবেকবান ও সামর্থ্যসম্পন্ন মানুষ যদি শিশুদের জন্য নিরাপদ ও আনন্দময় পরিবেশ নিশ্চিত করতে এমন ছোট ছোট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলেই কল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে প্রত্যেক মানুষকে প্রথমেই সুনাগরিক হতে হবে। আর এ সুনাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে জনকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করা। নাগরিকদের অংশগ্রহণ ছাড়া সরকারের একার পক্ষে ভালো কিছু করা অসম্ভব। প্রতিটি নাগরিকেরই দায়িত্ব দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা, তা যত ছোটই হোক না কেন। কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সরকারকে যথাসম্ভব সহযোগিতা করতে হবে। নাগরিকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। একটি মানবিক ও কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে ‘নেয়ার’ মানসিকতার পরিবর্তে ‘দেয়ার’ মানসিকতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। মানুষের কল্যাণ তথা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য সবার মধ্যে উৎসাহ তথা অনুপ্রেরণার সঞ্চার করতে হবে প্রত্যেক সুনাগরিকেরই। আমাদের মানবিক ও কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই সমাজ তথা দেশের প্রতি আমাদের যে ঋণ বা দায়বদ্ধতা আছে, তা শোধ করতে হবে।

নানা ধরনের সমাস্যা ও সম্পদের স্বল্পতার কারণে আমাদের দেশে এখনও পুরোপুরিভাবে শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা এবং শিশুর উপযোগী সুবিধা নিশ্চিত করার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। অথচ শিশুরাই হচ্ছে একটি দেশের ভবিষ্যৎ। প্রতিটি ক্ষেত্রে শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন শিশুবান্ধব ব্যক্তি এবং তিনি সবসময় শিশুদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে সমাজের প্রতিটি মানুষকে যথাসম্ভব অবদান রাখতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে শিশুদের জন্য বাসযোগ্য পরিবেশ তথা ‘শিশু আনন্দ ভুবন’ প্রতিষ্ঠায়।

আবদুর রহমানের মতো সন্তানহারা বাবা-মায়ের উদ্যোগ লক্ষ প্রাণে ছড়িয়ে পড়লে শিশুদের জন্য নিরাপদ ও আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হবে। সর্বত্র শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির একটি সামাজিক অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হবে। এক আবদুর রহমানের হাসি খুঁজতে গিয়ে লাখো শিশুর হাসিতে উদ্ভাসিত হবে এদেশের ভবিষ্যৎ। এভাবেই ছোট ছোট ভালো প্রয়াস একেকটা প্রদীপের মতো আলো জ্বেলে ভালোবাসা আর মানবিকাতার আলোয় আলোকিত করবে সমগ্র দেশকে এ প্রচেষ্টা আর অঙ্গীকার সামনে রেখে এগিয়ে যাক দেশ, আবদুর রহমানের বাবা-মায়ের মতো এগিয়ে যাক অন্য বাবা-মায়েরা, এগিয়ে যাই আমরা সবাই।

পিআইডি নিবন্ধ