২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সরকারের নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা তিন বছর আগে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। বাংলাদেশ সরকার এবং ইউএনএইচসিআর’র তত্ত্বাবধায়নে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এসব রোহিঙ্গার খাদ্য, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন অফিস ৩৪টি শরণার্থী ক্যাম্পে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ওপর চাপ কমাতে এবং শরণার্থীদের অধিকতর উন্নত পরিবেশ দিতে সরকার নোয়াখালীর ভাসানচরে এক লাখ শরণার্থীকে স্থানান্তরের জন্য স্থাপনা তৈরি করেছে, যেখানে ইতোমধ্যে প্রায় ১৮ হাজার শরণার্থীকে স্থানান্তর করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ দ্বীপ মনে হলেও গত ১৫০ বছরের আবহাওয়া ও দুর্যোগকে বিবেচনায় রেখে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দ্বীপটিকে শরণার্থীদের জন্য সাজানো হয়েছে।
বাংলাদেশ এমনিতেই ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশ সবদিক দিয়েই ঝুঁকি রয়েছে। রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসের কথা থাকলেও তারা কাজের সন্ধানে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে।
দেশের একটা বৃহৎ চক্র এদের দিয়ে অপরাধমূলক কাজ করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু দেশের কুচক্রী মহল দিয়ে নয়, বিদেশি কুচক্রী মহলের দ্বারাও রোহিঙ্গারা নিজেদের স্বার্থের জন্য দেশের ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করছে। অবৈধভাবে বাংলাদেশের ভোটার বানিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দিচ্ছে, ছিনতাই, চুরিসহ বিভিন্ন রকমের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ অনেকটা এককভাবেই মোকাবিলা করছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট। দুই দফা প্রত্যাবাসন চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এখনও চলমান করোনা মহামারিতে আটকে আছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার আলোচনা। করোনার দোহাই দিয়ে মিয়ানমার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে দীর্ঘ করতে পারে। তাই সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর বহুমাত্রিক চাপ বাড়াতে হবে।
উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বসবাসের কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত নানা সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ছে জনসংখ্যা। হচ্ছে অপরাধ। রয়েছে ভয়াবহ করোনা ঝুঁকিতে। এদিকে রোহিঙ্গাদের বাসস্থানের কারণে উজার হচ্ছে বন। সামাজিক, অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাব পড়ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এ নিয়ে দিন দিন তৈরি হচ্ছে অসন্তোষ।
বাংলাদেশের পক্ষে অনিশ্চিতকালের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া নিঃসন্দেহে অসুবিধাজনক। এ বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর উপস্থিতির কারণে একদিকে যেমন আমাদের আর্থসামাজিক ও পরিবেশ-প্রতিবেশগত সমস্যা হচ্ছে, অন্যদিকে কখনও তারা নিজেরা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে; এ কারণে অনেক সময় খুনের ঘটনাও ঘটছে। এদিকে রোহিঙ্গারা প্রায়ই ক্যাম্প থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এতে দেশে যেকোনো সময়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। যদিও সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য নির্ধারিত ক্যাম্প থেকে বের হওয়া আইনত নিষেধ করেছে, কিন্তু এটা কার্যকর করা দুরূহ হবে। এখানে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে প্রান্তিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মৌলিক মানবাধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত। ফলে তাদের পক্ষে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া খুবই সহজ। তাদের মানসিক অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কোনো কোনো মহল তাদের জঙ্গিবাদের দিকে প্ররোচিত করতে পারে। তা ছাডা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের জনসাধারণ এখন বেশ সোচ্চার হয়ে আছে। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার তাদের ক্রুদ্ধ করে তুলছে। এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তাদের উগ্র মতাদর্শের দিকে ধাবিত করতে পারে।
রোহিঙ্গা সমস্যা খুবই জটিল। বিপুল সংখ্যায় রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে আগমন এ দেশের সীমিত সম্পদের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের জন্য সমস্যাটা বেশি প্রকট হয়ে উঠছে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে। বাংলাদেশকে অবশ্যই একটা সমন্বিত সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য একটা সার্বিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। অন্যথায় বিদ্যমান অবস্থা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।
মানবিক কারণেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এই মানবিক কারণেই নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়ছে দেশটি। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের পক্ষে এত শরণার্থীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া রোহিঙ্গারা শতভাগ নিরক্ষর হওয়ায় খাওয়া, ঘুম আর যৌনতা ছাড়া তারা কিছু বুঝে না। ফলে তাদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় দ্রুতই। রোহিঙ্গাদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবস্থায় ভয়াবহ ধস নামতে পারে। এতে করে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই নতুন করে রোহিঙ্গা প্রবেশ যেমন ঠেকাতে হবে, তেমনি পুরোনো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে বাধ্য করার উপায়ও খুঁজে বের করতে হবে।
প্রসেনজিৎ চন্দ্র শীল
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা কলেজ