তরতর করেই বাড়ছে ডলারের বিনিময় মূল্য

শেখ আবু তালেব: বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মাধ্যমে দেশের আমদানি বিল পরিশোধ করে। গত বছরের সর্বশেষ প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়েছে নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে। এতে একসঙ্গে মোটা অঙ্কের দায় পরিশোধ ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় ডলারের ওপর চাপ আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে এক দিনের ব্যবধানেই টাকার বিপরীতে বিনিময় মূল্য বেড়েছে ৩০ পয়সা।

গত ৩০ ডিসেম্বর দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। আকুর বিল পরিশোধ শেষে ৫ জানুয়ারি তা দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এতেই ডলারের ওপর চাপ বেড়েছে। সর্বশেষ গতকাল প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়। এক বছর আগে ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। এ হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে দেশি মুদ্রা অবমূল্যায়িত হলো এক টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।

এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মানের অবমূল্যায়নকে স্বাগত জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের (বিজিএমইএ) সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে ডলারের বিপরীতে। করোনা মহামারির সময়ে তারা মুদ্রার মান অবমূল্যায়ন করেই চলছে, কিন্তু সেই তুলনায় বাংলাদেশ এখনও সেভাবে অবমূল্যায়ন করেনি। রপ্তানিবান্ধব কারেন্সি করতে তথা রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে টাকার মান আরও অবমূল্যায়ন করা উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা হলেও খোলা বাজারে তা ৯২ টাকায় উঠেছে। জানা গেছে, জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএন-এসক্যাপ) উদ্যোগে আকু গঠন করা হয়। বাংলাদেশ প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর বিল পরিশোধ করে।

আগে দেশের আমদানি দায় নিয়মিত পরিশোধ করত বাংলাদেশ। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার ওপর রিজার্ভের চাপ কমিয়ে আনা ও বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণে আকুর সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আমদানি দায় পরিশোধ করে তিন মাস পরপর। প্রথমদিকে ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয়ে ১৯৭৪ সালে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন গঠন করা হয়। পরে বাংলাদেশ, মিয়নমার, মালদ্বীপ ও ভুটান আকুর সদস্য হয়। বর্তমানে ৯টি দেশ আকুর সদস্য।

চলতি বছরের প্রথম দিকে আকুর বিল পরিশোধ করায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কমে গেছে। পাঁচ দিনের ব্যবধানে রিজার্ভের পরিমাণ কমেছে ১৭০ কোটি ৯৬ লাখ ডলার।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশকে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে হয়। তবে বর্তমানে রিজার্ভ দিয়ে বাংলাদেশ ছয় মাসের আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারবে।

এদিকে চাহিদা মেটাতে নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সরবরাহ করে চলছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। এতে করে ব্যাংকগুলো ডলার পেলেও নগদ টাকা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ডলারের বিপরীতে টাকা ঢুকে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে, যার ফলে প্রতিনিয়ত ব্যাংকগুলোর তারল্য কমে যাচ্ছে।

এদিকে ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন আমদানিকারকরা। একদিকে করোনায় সামুদ্রিক জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি, কন্টোইনার সংকটে পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। কাঁচামাল ও উৎপাদনে মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে বর্ধিত দামে। এর সঙ্গে ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি যোগ হচ্ছে পণ্যের উৎপাদন খরচে। ফলে শেষ পর্যায় গিয়ে ভোক্তাসাধারণকে আগের চেয়ে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে, যা উসকে দিচ্ছে মূল্যস্ফীতিকে।

আমদানি খরচ বাড়ায় এরই মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে চাল, ডাল, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল, শিশুখাদ্য, মসলা, গম, বিমানের টিকিট ও বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার খরচে। বাড়ছে মূল্যস্ফীতি, কমে যাচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) জাতীয় বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে পাঁচ শতাংশের ঘরে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। গড় মূল্যস্ফীতি এখন পাঁচ দশমিক ৯৮ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে, কিন্তু বাস্তবে কয়েকটি পণ্যে মূল্যস্ফীতি এর চেয়েও বেশি বেড়েছে।

অবশ্য টাকার অবমূল্যয়নের বিষয়টিতে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন না বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, টাকার অবমূল্যায়নটি ধীরে ধীরে হওয়া উচিত। আরও হতে পারে। এটি নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু হয়নি। বর্তমানে ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের বিনিময় মূল্যের পার্থক্য পাঁচ টাকায় পৌঁছেছে। এটি দুই টাকার মধ্যে থাকা উচিত।

আবার ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধিতে রপ্তানিকারকের এতে খুব বেশি সুবিধা হয় না বলে মনে করেন রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) সভাপতি ও এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুস সালাম মুর্শেদি। তিনি সম্প্রতি শেয়ার বিজকে বলেন, ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধিতে রপ্তানি বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়ে না। কারণ পণ্যের কাঁচামাল আমদানি ডলারে হলে রপ্তানিও ডলারেই হয়। লভ্যাংশের অংশটুকু শুধু টাকায় রূপান্তরিত হয়, কিন্তু স্থানীয় বাজারের পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়ে।