মোতাহার হোসেন: সম্প্রতি একটি খবর কমবেশি দেশ-বিদেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি হচ্ছে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র তথা ট্রাম্প প্রশাসন। গত ১ জুন হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ঘোষণা দেন। তবে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এ চুক্তি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে সম্মতি জানিয়েছে। তারা মনে করছে, বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস এবং জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে প্যারিস চুক্তি সম্পাদিত হয়। উন্নত সমৃদ্ধ দেশ এ চুক্তি থেকে সরে এলে বা সরে আসার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশসহ অপরাপর জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশের জন্য দুশ্চিন্তার। শুধু বাংলাদেশ কেন, বোধ করি বিশ্বনেতাদের বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কারণ আছে। পৃথিবী নামের গ্রহটি কোনো কারণে বিশেষ করে অতিমাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হলে অ্যান্টার্কটিকার বরফের পাহাড় বা বরফখণ্ড ভেঙে পুরো পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একইভাবে বরফবেষ্টিত হিমালয়ের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যাবে বেড়ে। তখন বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য বিপর্যয় ঢেকে আনবে। এ অবস্থায় পৃথিবী একদিকে ‘উত্তপ্ত উনুনে’ পরিণত হবে অন্যদিকে অ্যান্টার্কটিকা আর হিমালয়সহ পৃথিবীর অন্যান্য বরফসমৃদ্ধ পাহাড় গলে সাগর, মহাসাগর, নদ-নদীর উচ্চতা বেড়ে উপকূলবর্তী অঞ্চলের মানুষকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করবে। এসব অঞ্চলের মানুষকে খাদ্য, বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানীয় জল ও স্বাস্থ্য সমস্যায় ফেলবে। খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে মারাত্মকভাবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ নিয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতাদের দ্রুতই একটি বিকল্প পথ বের করতে হবে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য দেশটির মিত্রসহ বিশ্বের অন্য উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এ সমস্যা কোনো বিশেষ দেশের নয়, সব দেশের।
উল্লেখ্য, প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ১৮৭ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ ২ শতাংশে নামিয়ে আনার পাশাপাশি জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে এজন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন, তার দেশ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে দাঁড়াবে। সম্প্রতি হোয়াইট হাউসে এ ঘোষণা দেন তিনি। অবশ্য নির্বাচনি প্রচারকালেই ট্রাম্প বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে তিনি প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসবেন। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পূরণে পদক্ষেপ নিলেন। অবশ্য এ ঘোষণায় তার দেশের কেউ কেউ খুশি হলেও নিন্দাও করেছেন অনেকে।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বোঝা হিসেবে দেখেন ট্রাম্প। তার মতে, এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষতিকর। চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে দেবে। ট্রাম্প তার ঘোষণায় বলেন, আমরা চাই না অন্য কোনো নেতা ও দেশ আমাদের আরও হাস্যস্পদ করুক। তারা তা পারবে না। অবশ্য প্যারিস চুক্তি বাতিল বিষয়ে ট্রাম্পের পদক্ষেপ নিয়ে ঘরে-বাইরে সমালোচনা হচ্ছে। চুক্তিটির সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার প্রতি মারাত্মক আঘাত ট্রাম্পের ঘোষণা। ট্রাম্পের ঘোষণায় হতাশ হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক এ চুক্তির ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
এ অবস্থায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে নেতৃত্বে আসতে তথা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত হচ্ছে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। প্যারিস চুক্তি থেকে ট্রাম্পের সরে আসার ঘোষণার পরই চীন ও ইইউ ব্রাসেলস সম্মেলনে এ বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দিয়ে তাদের অবস্থান জানায়। জি-সেভেন সম্মেলনে প্যারিস চুক্তি কার্যকরে জোটভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ঐক্য জানাতে অস্বীকার করেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের সরে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে এ ব্যাপার আর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব থাকছে না। ব্রাসেলসে চীন ও ইইউ নেতাদের বিবৃতি প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে এ যাবৎকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে মনে করা হচ্ছে। বিবৃতির খসড়া হাতে পাওয়ার পর একটি সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, চুক্তি বাস্তবায়নে নেতারা ‘সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি’ দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, চীন ও ইইউ’র এ অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা চাপে ফেলবে।
সম্প্রতি জার্মানি সফরে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে চীন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এটি চীনের আন্তর্জাতিক দায়িত্বের অংশ।
চীন নিজের স্বার্থেই জলবায়ু পরিবর্তন রোধে লড়বে। এ ইস্যুতে অন্যান্য দেশের কাছে দৃষ্টান্ত হতে চায় চীন। কেকিয়াং বলেছেন, প্যারিস চুক্তি কার্যকরে ভূমিকা রাখতে চাই। তবে এজন্য অন্য দেশগুলোর সহযোগিতাও প্রয়োজন।
রাশিয়া বলেছে, প্যারিস চুক্তিবিষয়ক প্রতিশ্রুতি পূরণে মস্কো প্রস্তুত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় একটি দেশ চুক্তি থেকে সরে গেলে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে পুরো প্রক্রিয়াটি হুমকিতে পড়বে বলে মনে করছে ক্রেমলিন।
অন্যদিকে প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। ট্রাম্পকে এ ইস্যু নিয়ে কার্যকরভাবে চিন্তা করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য, গত এক বছরের বেশি সময় চীন ও ইইউ জলবায়ু পরিবর্তন এবং ‘ক্লিন এনার্জি’ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়ার জন্য কাজ করছে। এতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিকে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু এবং সামজিক ও রাজনৈতিক ভঙ্গুরতার উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। খসড়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপক উন্নয়নে প্যারিস চুক্তিকে ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে বিবেচনা করে ইইউ ও চীন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেই মানবসৃষ্ট এ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সতর্কতাকে ‘ভাঁওতাবাজি’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এ বিষয়ে এরই মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একজোট হয়ে লড়াইয়ের জন্য ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে এক সম্মেলনে ১৯৭টির মধ্যে ১৯৫টি দেশ প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে সই করে। শুধু সিরিয়া ও নিকারাগুয়া চুক্তিটিতে সই করেনি। ওই চুক্তিতে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা এবং নিয়মিত অগ্রগতি পর্যালোচনার বিষয়ে দেশগুলো নিজেরা আইন তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে প্রতিশ্রুতি পূরণে দেশগুলোর ওপর কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা প্যারিস চুক্তিতে রাখা হয়নি। ঐতিহাসিক ওই চুক্তি অনুযায়ী, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস অবশ্য বলেছেন, কোনো একটি দেশ এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলেই চুক্তিটি শেষ হয়ে যেতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে তার শূন্যতা পূরণ করবে অন্যরা। তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলায় সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি ‘একেবারেই অপরিহার্য’।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কার্যকর করতে ৫৫টি দেশের সমর্থন দরকার, যার লক্ষ্য কার্বন নিঃসরণ ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা।
জলবায়ু চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত অবস্থানের মধ্যেই ট্রাম্পকে যেন বার্তা দিচ্ছে বরফের মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকের ফাটল ধরা সর্ববৃহৎ বরফখণ্ড। গত জানুয়ারিতে ফাটলটি বিজ্ঞানীদের নজরে আসে। তবে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, বরফখণ্ডটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। বর্তমানে এটি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রায় দ্বারপ্রান্তে। গত জানুয়ারিতে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেন, অ্যান্টার্কটিকার এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় ১০টি হিমশৈলের একটি যে কোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। গত বছরের ডিসেম্ব^রে হঠাৎ করে ‘লারসেন সি’ নামের বরফ পর্বতে একটি দীর্ঘ ফাটল দেখা দেয় এবং এ হিমশৈলের সৃষ্টি করে। তখন ওই বিশাল বরফখণ্ডের ২০ কিলোমিটারের বরফে ফাটল ধরা বাকি ছিল। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন চলতে থাকলে পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটারের হিমশৈলটি মুক্তভাবে ভেসে বেড়াবে। লারসেন সি হচ্ছে অ্যান্টার্কটিকার উত্তরের একটি বড় ধরনের বরফ পর্বত। ধীরে ধীরে এ বরফপিণ্ড সরে আসবে তার অবস্থান থেকে।
আমাদের প্রত্যাশা, অ্যান্টার্কটিকার বরফপিণ্ড যেভাবে অবস্থান থেকে সরে আসছে, তেমনই মানবজাতির স্বার্থে পৃথিবীকে রক্ষার স্বার্থেই বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে না গিয়ে এর যথাযথ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে।
সাংবাদিক
motaherbd123Ñgmail.com