পদ্মা সেতু রক্ষণাবেক্ষণ

পাঁচ বছরে ব্যয় হবে ১২১৭ কোটি টাকা!

নির্মাণ শেষের পথে দেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামো পদ্মা সেতুর। চলতি বছর জুনে সেতুটি উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এখন সেতুটির নির্মাণ-পরবর্তী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষ। তাই পদ্মা সেতুর সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে প্রথম পর্ব

ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯৬ শতাংশ। এখন চলছে পিচ ঢালাইসহ অন্যান্য কাজ, যা এপ্রিলের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আগামী জুনে সেতুটি উদ্বোধনের কথা রয়েছে। আর সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পাচ্ছে এর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ করপোরেশন (এমবিইসি) ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি)। পাঁচ বছর যৌথভাবে এ দায়িত্ব পালন করবে কোম্পানি দুটি।

যদিও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অনেক বেশি দরপ্রস্তাব করেছে এমবিইসি ও কেইসি। পাঁচ বছরের জন্য দুই কোম্পানি এক হাজার ২১৭ কোটি টাকা দাবি করেছে। তবে এ প্রস্তাবকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। এজন্য তা কমিয়ে যৌক্তিক দর প্রস্তাব করতে বলা হয়েছে কোম্পানি দুটিকে।

সূত্রমতে, নির্মাণশেষে এক বছর পদ্মা সেতু রক্ষণাবেক্ষণ করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ, যা ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড হিসেবে বিবেচিত। এরপর বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) কাছে পদ্মা সেতু হস্তান্তর করা হবে। তখন জিটুজি ভিত্তিতে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হবে এমবিইসি ও কেইসিকে।

যদিও পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ে ২০১৯ সালে প্রথম এককভাবে আগ্রহ দেখায় কেইসি। জিটুজি ভিত্তিতে এ কাজ করার প্রস্তাব দেয় কোম্পানিটি। ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর কেইসি এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব জমা দেয়। আর ২০২০ সালের ২০ আগস্ট অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি জিটুজি ভিত্তিতে তা বাস্তবায়নে সম্মতি দেয়। পাশাপাশি এমবিইসিও পদ্মা সেতু রক্ষণাবেক্ষণে আগ্রহ দেখায়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমবিইসিকেও কেইসির সঙ্গে পদ্মা সেতু রক্ষণাবেক্ষণে যুক্ত করার পরামর্শ দেয় সেতু কর্তৃপক্ষের গঠিত কারিগরি কমিটি। কারণ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেতুর প্রতিটি বিষয় তাদের জানা আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর আগস্টে পদ্মা সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ে যৌথ কারিগরি প্রস্তাব জমা দেয় কেইসি-এমবিইসি জেভি। তা অনুমোদন করা হলে ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর আর্থিক প্রস্তাব জমা দেয় কোম্পানি দুটি।

এতে দেখা যায়, সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণে জনবল লাগবে ৭৩৯ জন। আর মোট যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হবে ১০৪টি। দুই ধাপে সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। প্রথম ধাপে প্রি-ওঅ্যান্ডএম (অপারেশন অ্যান্ড মেনটেইন্যান্স) পিরিয়ডে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। আর দ্বিতীয় ধাপে ব্যয় হবে ৭৫৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে দুই ধাপে ব্যয় হবে এক হাজার ২১৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সফটওয়্যারভিত্তিক টোল ও ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা চালু বাবদ ১৮০ কোটি টাকা ও অন্যান্য সিস্টেম চালু বাবদ ৫৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় হবে। আর মূল পরামর্শক ও অন্যান্য স্টাফদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হবে ৩২৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

প্রস্তাবটি মূল্যায়নে কারিগরি কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করেছে। এতে এমবিইসি-কেইসির প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে বেশকিছু মন্তব্য তুলে ধরে। এর মধ্যে জনবল কমিয়ে ৫৯০ জন নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। এক্ষেত্রে বৈদেশিক বিশেষজ্ঞ চারজন ও স্থানীয় নন-কি এক্সপার্ট ২৯ জন বাদ দেয়া হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রস্তাবিত যন্ত্রপাতির দর ওয়েবসাইট থেকে যাচাই-বাছাই করেও অতিরিক্ত পাওয়া যায়। সেগুলো কমিয়ে যুক্তিসংগত দর নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে।

এদিকে মূল প্রস্তাবে যানবাহন ও যন্ত্রপাতি রয়েছে ১০৪টি। তবে কারিগরি কমিটি তা কমিয়ে ৮৬টি নির্ধারণের প্রস্তাব করে। এছাড়া মাওয়া ও জাজিরা সংযোগ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাদ দেয়া হয়েছে। এগুলো সেতু কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রক্ষণাবেক্ষণ করবে। একইভাবে সার্ভিস এরিয়া-২ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব লিজ দেয়া আছে বিধায় ওই অংশটিও বাদ দেয়া হয়েছে।

সব মিলিয়ে দুই ধাপে সেতু পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রথম ধাপে প্রি-ওঅ্যান্ডএম পিরিয়ডে ব্যয় হবে ২৮৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আর দ্বিতীয় ধাপে ব্যয় হবে ৩৫১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

জানতে চাইলে কারিগরি কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, এমবিইসি-কেইসির প্রস্তাবে অস্বাভাবিক দর চাওয়া হয়েছে। তবে তাদের সঙ্গে এখনও দরকষাকষি শুরু করা হয়নি। কারণ তাদের প্রস্তাবে ব্যয় অনেক বেশি মনে হয়েছে। তাই যৌক্তিক আর্থিক প্রস্তাব জমা দিতে বলা হয়েছে কোম্পানি দুটিকে। পাশাপাশি কোন খাতে কত ব্যয় হবে তা আরও বিস্তারিতভাবে জমা দিতে বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, জানুয়ারি পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৯০ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৯৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। এছাড়া নদীশাসন শেষ হয়েছে ৮৮ শতাংশ। সর্বশেষ সংশোধিত পরিকল্পনা অনুসারে, আগামী ২৩ এপ্রিল মূল সেতু এবং ২০ জুন নদীশাসনের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।