আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: প্রকৃতিতে কোনো জীবই পরিবেশের কোনো ধরনের আনুকূল্য ছাড়া এককভাবে বাঁচতে পারে না। একটি জীব পরিবেশের অংশ হিসেবে কোনো না কোনো দিক দিয়ে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এই প্রক্রিয়াকে জীবের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বলে। মানবজাতি এখন খাদ্যের জন্য শিকারের ওপর নির্ভরশীল নয়। তারপরও আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি অতিমাত্রায় পুড়িয়ে পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। এ জন্যই জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির মুখে। এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী প্রধানত মানুষ। অতিরিক্ত মাত্রায় প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, বিশেষ করে শিল্প-বিপ্লবের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি অতিমাত্রায় ব্যবহার করে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে। ফলে পৃথিবী নামক গ্রহকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে মানুষসহ সব প্রাণী এবং উদ্ভিদ হুমকির মধ্যে আছে। হুমকির মধ্যে আছে অসংখ্য, অগণিত জীববৈচিত্র্য ও প্রাণীবৈচিত্র্য। জলবায়ু বিপর্যয়ের জর্জরিত এই আগ্রাসনের কারণে আমরা আজ দিশেহারা। মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মানুষ ইচ্ছা করলে এ জলবায়ু বিপর্যয় অনেকাংশে শিথিল করতে পারে বা লাগাম টেনে ধরতে পারে। লাগাম টেনে ধরা অন্যতম মাধ্যম হলো, আমাদের দৈনন্দিন কাজে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা। ব্যক্তি পর্যায়েও আমরা জলবায়ু বিপর্যয় প্রতিরোধে কাজ করতে পারি এবং করার সুযোগ আছে। আমরা মানুষ হিসেবে সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর অস্তিত্বকে রক্ষার চেষ্টা করব কি না, তা আমাদের বিবেক থেকে আসতে হবে।
প্রতিদিন অকারণে আমরা একবার ব্যবহার করা প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ, স্ট্র, কাপ, প্লেট, চামচ, খাবারের বক্স ইত্যাদি ব্যবহার করছি, এগুলোর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে পারি। সামাজিক সংগঠনগুলো সভা, সমাবেশ ও অনুষ্ঠান আয়োজনের নামে যাতায়াতে অযাচিত ব্যক্তিগত যান্ত্রিক বাহন ব্যবহার করে, তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও বন্ধ করতে পারি। এছাড়া অনুষ্ঠানগুলোয় একবার ব্যবহার করা প্লাস্টিকের বোতল, কাপ, প্লেট, চামচ, স্ট্র, পলিথিন ব্যাগ ইত্যাদি এগুলোর ব্যবহার রাষ্ট্র আইন করে ও আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টি করে কাজ করতে পারে। বিশেষ করে প্রতিটি এলাকায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা গেলে শিক্ষার্থী নিজের এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করলে, যাতায়াত এ যান্ত্রিক যানবাহন নির্ভরতা আর থাকবে না। তখন তারা হেঁটে, বাইসাইকেল বা রিকশা করে যাতায়াত করতে পারবেন। ফলে কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রাও কমে যাবে। কারণ আমরা জানি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো হলে কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরিত হয়। যেহেতু যান্ত্রিক যানবাহনগুলোয় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। আর প্লাস্টিক উৎপাদন করতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবার প্লাস্টিকের বর্জ্য পোড়ানো হলেও বায়ুদূষণের কারণে ভূপৃষ্ঠে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এর ব্যবহার ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করতে পারি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধ করতে দরকার সরকারগুলোর আন্তরিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
যদিও জাতিসংঘসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছে, জীবাশ্ম জ্বালানি অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে সারা পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। যে কারণে সূর্য থেকে আগত অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে আমাদের পৃথিবীর অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী কণা ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং বিলুপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়া এখনও চলমান। এছাড়া উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। খাদ্য শৃঙ্খলের শ্রেণি বিভাগ একটার সঙ্গে একটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বিধায় জলবায়ু বিপর্যয় আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলের ওপরে একটা আঘাত হানবে। এই আঘাতে মানুষ কখনও টিকে থাকতে পারবে না; কারণ খাদ্যের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশসহ সুমেরু এবং কুমেরু অসংখ্য বিশাল বিশাল স্তূপের বরফখণ্ড গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অতি দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। যার কারণে পৃথিবীর অনেকাংশেই বিশেষ করে সমুদ্র এলাকাগুলো পানির নিচে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে মালদ্বীপসহ পৃথিবীর অনেক ছোট ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র বিলীন হওয়ার পথে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লবণাক্ততা পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক নিন্মাঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠ এলাকাগুলো কৃষি উৎপাদন ইতোমধ্যেই ব্যাঘাত ঘটছে। ওইসব এলাকার মানুষ দিনে দিনে উদ্বাস্তু হচ্ছে। যদিও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এসব জলবায়ু বিপর্যয়তে উদ্বাস্ত হওয়া মানুষকে স্বীকার করতে চায় না। বিশেষ করে কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো।
জি-২০ রাষ্ট্রগুলো কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তারা দেখেও না দেখার ভান করছে এবং বুঝেও না বুঝার ভান করছে; যা কিনা জ্ঞান পাপি বলা যেতে পারে। কিছু ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য দায়ী রাষ্ট্রগুলোর কাজে ক্ষতিপূরণ যাচ্ছে, কিন্তু তারা ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি নয়। দায়ী দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধে আমাদের চাপ প্রয়োগ করা উচিত, নাকি ক্ষতিপূরণ চাওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন? মানুষের অস্তিত্ব না থাকলে ক্ষতিপূরণের অর্থ ভোগ করবে কে? এটাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই ওইসব ঘুমন্ত দেশ, জাতি ও জাতীয় নেতাদের ঘুম ভাঙানোর জন্য এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের হাত থেকে সারা পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বিভিন্ন দেশের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, সমাজকর্মী, এনজিও প্রতিনিধিরা ফ্রাইডে ফর ফিউচার নামে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করছে। নিজ নিজ রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রপ্রধান এবং জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের কাছে ভিডিও ডকুমেন্টারিসহ স্মারকলিপি ও চিঠি প্রদান করে থাকে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার্থে ওই কাজগুলো মূলত শুক্রবারে করে থাকে বিধায় ওকে ফ্রাইডে ফর ফিউচার নামে ঢাকা হয়। পৃথিবী রক্ষার ওই আন্দোলনের সঙ্গে ৫০ লাখের অধিক তরুণ শিক্ষার্থী যুক্ত হয়। যদিও করোনার কারণে ও কার্যক্রম এখন অনেকাংশে স্থিতির রয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে নাতিশীতোষ্ণ পৃথিবী নামক গ্রহকে করেছে উত্তপ্ত। ফলে পৃথিবীর অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী এখন বিলুপ্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ না করলে অচিরেই পৃথিবী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। আর এজন্য দায়ী থাকবে মানুষ।
প্রতি বছর বিভিন্ন দিনে বিশ্বব্যাপী নানা দিবস পালিত হয়ে থাকে। দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধি বা ক্ষেত্রবিশেষে কোনো অতীত ঘটনা স্মরণ বা উদযাপন করা। এরকম একটি দিবস বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪৪তম অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৯২ সালের ৩-১৪ জুন ব্রাজিলের রিওডিজেনেরিও শহরে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়নের প্রথম সম্মেলন হয়। জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলন বা United Nations Conference on Environment and Development (UNCED) , যা বিশ্বব্যাপী ধরিত্রী সম্মেলন নামে পরিচিত। সাধারণত প্রতিটি দিবসেই ‘প্রতিপাদ্য’ নির্ধারণ করা হয়; যা দিবসটির ভূমিকাকে সর্বসমক্ষে আরও গুরুত্ব ও অর্থবহ করে তোলে। এবার বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে প্রতিপাদ্য ‘ওহাবংঃ ওহ ঙঁৎ চষধহবঃ.’
প্রতি বছর ২২ এপ্রিল পৃথিবীব্যাপী সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব ধরিত্রী দিবস পালিত হয়ে আসছে। পরিবেশ এবং প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার মাধ্যমে ধরিত্রীকে টিকিয়ে রাখাই এ দিবসটির লক্ষ্য। সর্বপ্রথম ১৯৭০ সালে মার্কিন সিনেটর গেলর্ড নেলসন ধরিত্রী দিবসের প্রচলন করেন। ফলে সে বছরই যুক্তরাষ্ট্রে এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তারা পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে কাজ করছে, বিশেষ করে শিল্পায়ন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ, কীটনাশক প্রভৃতির বিরূপ প্রভাবের বিষয়টি মানুষের মাঝে তুলে ধরেন। নতুন শতাব্দীর শুরুতে ২০০০ সালে বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে জলবায়ু বিপর্যয় রোধে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। তাই এখনই সরকারকে প্রাণ-প্রকৃতি অস্তিত্ব রক্ষায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাই।
আইনজীবী
masumbillahlaw06@gmail.com