আলাপচারিতায় দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

বিদেশি ঋণে স্বস্তিকর অবস্থা তিন বছরে ফুরিয়ে যাবে

নিজস্ব প্রতিবেদক: উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সরকার যেসব বড় বড় ঋণ নিয়েছে, সেগুলোর রেয়াতি সময়কাল (গ্রেস পিরিয়ড) আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। ফলে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পরে বিদেশি দায়দেনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বস্তিকর অবস্থা আর থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

গতকাল জুম প্ল্যাটফর্মে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পরে বিদেশি দায়দেনায় অস্বস্তিকর অবস্থানে চলে যেতে পারে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ সবুজ (স্বস্তিকর) অবস্থানে আছে। এটি ধীরে ধীরে হলুদ অবস্থানে (অস্বস্তিকর) যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আপাত স্বস্তি নাও থাকতে পারে। এখন আমরা বিদেশি দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে বেশি সুদের ঋণ বেশি নিচ্ছি। যেমন চীন, রাশিয়া ও ভারত থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছি। এসব দেশের ঋণের রেয়াতি সময় (গ্রেস পিরিয়ড) শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া সরবরাহকারী ঋণের পরিমাণও বাড়ছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, বহুপক্ষীয় উৎসের (বিশ্বব্যাংক, এডিবি প্রভৃতি) ঋণ অনেকটা সাশ্রয়ী। বর্তমানে পাইপলাইনে ৫০ বিলিয়ন ডলারের মতো সাশ্রয়ী ঋণ রয়েছে, যেগুলো ব্যবহার করতে পারছি না। অথচ দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছি।

বিদেশি দায়দেনার পাশাপাশি দেশি উৎসের দায়দেনাও কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার মতে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি সুদে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। গত তিন বছরে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশিÑদুই উৎস থেকেই ঋণ নেয়া বেড়েছে। আবার বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর, নির্বাচনের বছর ও পরের বছর ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। দেশের দায়দেনা পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় নির্বাচনী চক্র সূচক হিসেবে উঠে আসছে।

বাংলাদেশে কি শ্রীলঙ্কার মতো সংকট হতে পারেÑএমন প্রশ্নের উত্তরে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমি তা দেখি না। কোনো দেশের সঙ্গে অন্য দেশের অবস্থা তুলনীয় নয়। মূল বিষয় হলো, শ্রীলঙ্কা থেকে কী শিখলাম। একসময় আমাদের দেশেও বন্ড ছাড়ার ধোয়া উঠেছিল। সরকার এ বিষয়ে রক্ষণশীল ছিল। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় হাম্বানটোটা বন্দর নিয়ে ওই দেশের বিশেষজ্ঞরা এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। তবু দেশটির সরকার তা করেছে।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একটি হিসাব করে দেখিয়েছেন, ২০২০-২১ অর্থবছরের সার্বিকভাবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে সরকারি দায়দেনা ৪৪ দশমিক ১০ শতাংশ। মাথাপিছু সরকারি দায়দেনা ৪৩২ ডলার। তিনি মনে করেন, সরকারি ঋণ পরিশোধসহ সার্বিক দায়দেনার পূর্ণাঙ্গ হিসাব করতে হলে বিদেশি ঋণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ঋণ, ব্যক্তি খাতের ঋণ, সরকারের সংযুক্ত দায়দেনাও বিবেচনায় আনা উচিত। এসব হিসাবে আনা হলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মূল্যায়ন থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, সরকারি দায়দেনা

পরিস্থিতির জন্য পাঁচ ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, যেমন বিনিময় হারের ঝুঁকি বাড়ছে, অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের হার বাড়ছে, বিদেশি ঋণের সুদের হার বাড়ছে, উচ্চমূল্যে প্রকল্প নেয়া হচ্ছে ও প্রকল্পের অর্থনৈতিক সুবিধা হ্রাস পাচ্ছে।

অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের সরকারি ঋণের পাশাপাশি বেসরকারি ঋণও গত ১০ বছরে অনেকটা বেড়েছে। বেসরকারি খাতে যারা নমনীয় লাইবর হারে ঋণ নিয়েছেন, তাদের সুদহার বাড়ছে। এ বিষয়টিও মাথায় রাখা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, এই ঋণ খেলাপি হলে দেশের ঋণমানে প্রভাব পড়বে।